ঐতিহ্য
স্টার থিয়েটার
সে যুগের বিখ্যাত অভিনেত্রী বিনোদিনী দাসীকে একান্ত আপন করে পাওয়ার জন্য তার নামে নতুন থিয়েটার খুলতে আগ্রহী হয় গুর্মুখ রায়। গুর্মুখ ছিলেন হোরমিলার কোম্পানির ‘বেনিয়ান’ গণেশদাস মু্সাদ্দির ছেলে। তার থিয়েটার-প্রীতির কারণও ছিল বিনোদিনী।

পুনর্গঠিত স্টার থিয়েটার

৬৮, বিডন স্ট্রিটের ফাঁকা জমি ইজারা নিয়ে গুর্মুখ রায়ের টাকায় থিয়েটার খোলা হয় বটে, কিন্তু বিনোদিনীর নামে নয়। ‘বারাঙ্গনা’ (যৌনকর্মীরা সে যুগে ওই নামে পরিচিত হতেন) অভিনেত্রীর নামে থিয়েটার হলে সামাজিক বাধা আসবে— এই যুক্তিতে গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও অন্যান্যদের চক্রান্তে থিয়েটারের নাম হয় ‘স্টার থিয়েটার’। ৩১ জুলাই, ১৮৮৩ গিরিশচন্দ্রর লেখা নাটক ‘দক্ষযজ্ঞ’ দিয়ে উদ্বোধন হয় প্রেক্ষাগৃহটির। তবে কয়েক বছর পরে পারিবারিক চাপে গুর্মুখ থিয়েটারের স্বত্ত্ব ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। মাত্র ১১ হাজার টাকার বিনিময়ে স্টারের মালিক হন অমৃতলাল বসু, অমৃতলাল মিত্র, হরিপ্রসাদ বসু ও দাসুচরণ নিয়োগী।

বিনোদিনী অবশ্য থেকে গেলেন স্টারের দলেই। তাঁর জীবনের সেরা অভিনয়গুলি ওই থিয়েটারে মঞ্চস্থ হলেও দলাদলি ও অপমানের কারণে তিনি অবসরও নেন ওখান থেকেই। ১ জানুয়ারি, ১৮৮৭-এ ‘বেল্লিকবাজার’ নাটকে রঙ্গিণীর ভূমিকায় অভিনয় করে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চ থেকে বিদায় নিলেন তিনি। এরই মাঝে, ২১ সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪-এ ‘চৈতন্যলীলা’র অভিনয় দেখতে এসে অভিনেতা অভিনেত্রীদের আশীর্বাদ করে যান শ্রীরামকৃষ্ণ।

বিনোদিনী অভিনয় ছেড়ে দেওয়ার অল্প দিন পরে স্টার থিয়েটারও প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। মালিকপক্ষ তখন ৩০ হাজার টাকায় তা বিক্রি করে দেয় ধনকুবের গোপাললাল শীলকে।
ওই প্রেক্ষাগৃহে ‘এমারেল্ড থিয়েটার’ নামে নতুন নাট্যদল গঠন করে গোপাললাল। সেটিও অবশ্য বেশি দিন চলেনি। পরে নানা হাত বদলের মধ্যে দিয়ে এক সময়ে তার নাম হয় ‘মনমোহন থিয়েটার’।

স্টার থিয়েটার

পুড়ে যাওয়ার পর
অন্য দিকে প্রেক্ষাগৃহ বিক্রির টাকায় হাতিবাগানের ৭৫/৩, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে ত্রিশ কাঠা জমি কেনা হয়। অন্যরা হাল ছেড়ে দিলেও গিরিশচন্দ্র ঘোষ রয়ে গেলেন নাট্য জগতেই। এমারেল্ড থেকে বোনাস হিসেবে পাওয়া ২০ হাজার টাকা থেকে ১৬ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলেন স্টারের নতুন বাড়ি তৈরির কাজ। নতুন থিয়েটারের জন্য গোপনে ‘নসীরাম’ নামে নতুন একটি নাটকও রচনা করেন গিরিশচন্দ্র। ২৫ মে, ১৮৮৮ তে মহা সমারোহে ‘নসীরাম’ নাট্যাভিনয় দিয়ে উদ্বোধন হয় নতুন প্রেক্ষাগৃহের। এবং কিছু দিন পর গিরিশচন্দ্রও এসে যোগ দিলেন সেখানে।

বাংলা পেশাদারি থিয়েটারে সেই সময়টা ছিল খুবই প্রতিযোগিতামুখী। এখনকার মতো সে যুগেও দর্শক টানবার জন্য থিয়েটার দলগুলি নানা চমক দিত। তেমনই এক চমক দিল অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফির মিনার্ভা থিয়েটার। ৩১ জানুয়ারি ১৮৯৭-এ অভিনয়ের পরিবর্তে দেখান হল মিস্টার সুলিভানের ‘animatograph’। বাংলা থিয়েটারে সেই প্রথম বায়োস্কোপের প্রদর্শন। মিনার্ভার দেখাদেখি অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ক্লাসিক থিয়েটারও বায়োস্কোপ দেখানো আরম্ভ করে ১৮৯৮-এর ১৯ মার্চ থেকে। আর ২৯ অক্টোবর ১৮৯৮ থেকে সিনেমা দেখানো আরম্ভ করে স্টার থিয়েটার। এই ধারা বজায় ছিল দীর্ঘ কাল। বাংলা রঙ্গমঞ্চের ধারাবাহিক অভিনয় বর্ণনা পাওয়া যায় ১৯১৯ সাল পর্যন্ত। ওই তালিকা থেকে জানা যায় যে ওই সময়ে স্টার থিয়েটারে মাঝে মধ্যেই বায়োস্কোপ প্রদর্শিত হত।

‘ঘটক বিদায়’ নাটকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও মাধবী চট্টোপাধ্যায়

প্রেক্ষাগৃহটি তৈরি হয়েছিল পেশাদার থিয়েটারের প্রয়োজনে। গিরিশ ঘোষের ‘নসীরাম’ থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ঘটক বিদায়’ পর্যন্ত প্রথম পর্বের একশো তিন বছরের ইতিহাসের পুরোটাই পেশাদারি থিয়েটারের ইতিহাস। এই শতাধিক বছরে ৮০ বা তারও বেশি বিশিষ্ট নাট্যকারের লেখা প্রায় ২৫০টি নাট্যপ্রযোজনা মঞ্চস্থ হয়েছে স্টার থিয়েটারে।

গত শতকের কুড়ির দশকে (১৯২৫-৩০) ‘নয়া রাস্তা’ সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ (বর্তমানে ওই অংশটির নাম যতীন্দ্রমোহন অ্যাভিনিউ) তৈরির সময়ে ভাঙা পড়ে প্রেক্ষাগৃহটি। থিয়েটার চত্বরে একটি শিবের মন্দির ছিল। রাস্তা তৈরির সময়ে শিবলিঙ্গটিকে রাস্তার পাশে স্থাপন করা হয়। আজও সেটি আছে ওই থিয়েটারের চিহ্ন হিসেবে। ১২ অক্টোবর, ১৯৯১— ভয়াবহ এক অগ্নিকাণ্ডে ভস্মীভূত হয় কলকাতা শহরের ঐতিহ্যমণ্ডিত এই প্রেক্ষাগৃহ। কলকাতা পুরসভা সেটিকে আবার নতুন করে গড়ে তোলে। প্রায় তেরো বছর পর পুনর্নির্মিত স্টার থিয়েটারের দ্বিতীয় পর্ব আরম্ভ হয় ২০০৪-এর অক্টোবরে। পরিকাঠামোর অভাব ও অন্যান্য কারণে সেখানে নিয়মিত ভাবে নাটক মঞ্চস্থ করতে না পারায় শেষমেশ সিনেমা প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় পুর-কর্তৃপক্ষ। সিনেমা দেখানো শুরু হয় ১ নভেম্বর, ২০০৬ থেকে।

হাতিবাগান স্টার থিয়েটারের সূচনা হয়েছিল গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘নসীরাম’ অভিনয় দিয়ে, ২৫ মে ১৮৮৮ সালে। হিসেব বলছে প্রেক্ষাগৃহের বয়স হল ১২৫ বছর। সেই উপলক্ষে এ বছর ২৫ মে কলকাতা পুরসভার উদ্যোগে, মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে, এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় সেখানে। অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে সম্মাননা জ্ঞাপন, ঋদ্ধি-দেবজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের গান ও নানাবিধ অনুষ্ঠানে মুখরিত হয় দিনটি।
‘নসীরাম’ নাটকের পুনরাভিনয় করে সম্মান জানানো হয় ‘নাট্যসম্রাট’ গিরিশ ঘোষকে।

তথ্য ও শিব মন্দিরের ছবি: গৌতম বসুমল্লিক
ফাইল চিত্র
 
 


 

Content on this page requires a newer version of Adobe Flash Player.

Get Adobe Flash player

 
অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.