প্রায় শ’দেড়েক মুমূর্ষু শিশু এই মুহূর্তে এসএসকেএম হাসপাতালের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগে নাম লিখিয়ে সুযোগ আসার অপেক্ষায় দিন গুণছে। এদের কারও বাইপাস সার্জারি প্রয়োজন, কারও বা ভাল্ভ প্রতিস্থাপন কিংবা হার্টের অন্য কোনও অস্ত্রোপচার। হাসপাতাল জানিয়ে দিয়েছে, পরিকাঠামো যথেষ্ট নেই, তাই এখনই অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব নয়। অন্য দিকে, সরকারি তালিকাভুক্ত তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে বকেয়া অর্থের পরিমাণ ক্রমশ বাড়তে থাকায় তারাও কত দিন অস্ত্রোপচার চালিয়ে যেতে পারবে সে নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে। সব মিলিয়ে, শিশু হৃদ্রোগীদের নিখরচায় চিকিৎসা দিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘শিশু সাথী’ নামে যে প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন, ছ’মাস না পেরোতেই সেই প্রকল্প এখন নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ কেন স্বাস্থ্য দফতরে সংশ্লিষ্ট স্তরগুলিতে যথাযথ ভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না, সে নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন স্বাস্থ্য কর্তাদেরই একাংশ।
কলকাতা এবং রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় সমীক্ষা চালানোর পরে গত বছরের অগস্টে প্রায় ৮০০০ শিশু হৃদ্রোগীর সন্ধান মেলে, যাদের দ্রুত অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। এক বছরের মধ্যে ওই শিশুদের অস্ত্রোপচার করানোর সিদ্ধান্ত নেন মুখ্যমন্ত্রী। সরকারি হাসপাতালগুলির মধ্যে থেকে এসএসকেএমকে এ জন্য বেছে নেওয়া হয়। কিন্তু শুধু এসএসকেএমে এই বিপুল সংখ্যক অস্ত্রোপচার সম্ভব নয় বুঝেই তিনটি বেসরকারি হাসপাতালকেও এই প্রকল্পে শরিক করা হয়। এই তিনটি হাসপাতাল হল কলকাতার বি এম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টার, রবীন্দ্রনাথ টেগোর ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সায়েন্সেস এবং দুর্গাপুরের মিশন হাসপাতাল। স্থির হয়, সরকারি তো বটেই, বেসরকারি হাসপাতালগুলিও নিখরচায় এই অস্ত্রোপচারগুলি করবে, আর সরকার তাদের বকেয়া মেটাবে।
কিন্তু ছ’মাসের মধ্যেই এই প্রকল্প নিয়ে ওই বেসরকারি হাসপাতালগুলির তরফে কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এসএসকেএম-কর্তাদেরও অভিযোগ, পরিকাঠামোর ব্যবস্থা না করেই তাদের উপরে বাড়তি বোঝা চাপানো হয়েছে। ফল যা হওয়ার তা-ই হচ্ছে। ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে অস্ত্রোপচারের অপেক্ষায় থাকা শিশুর সংখ্যা।
নিয়ম অনুযায়ী, শিশুর ওজন ১০ কিলোগ্রামের কম হলে কিংবা সংশ্লিষ্ট শিশুর অস্ত্রোপচারে যথেষ্ট ঝুঁকি থাকলে সেগুলি বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করার কথা। কারণ এসএসকেএমের চিকিৎসেকরা স্বীকার করেছেন, অস্ত্রোপচার পরবর্তী সঙ্কট মোকাবিলার জন্য যে ধরনের পরিকাঠামো প্রয়োজন, তা ওখানে মজুত নেই।
গত সেপ্টেম্বরে জোড়াবাগানের সন্দীপা বিশ্বাস নামে চার বছরের একটি মেয়ের হার্টের অস্ত্রোপচার হয় কলকাতার বি এম বিড়লা হার্ট রিসার্চ সেন্টারে। স্বাস্থ্যকর্তারা ঘোষণা করেন, শিশুদের নতুন জীবন দেওয়ার পথ চলা শুরু হল। এর পরে কয়েকশো শিশুর অস্ত্রোপচার হয় তালিকাভুক্ত সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে। কিন্তু প্রাথমিক উচ্ছ্বাস থিতিয়ে যেতেই প্রকল্পের গতি মুখ থুবড়ে পড়েছে বলে অভিযোগ। সরকারের কাছে বেসরকারি হাসপাতালগুলির বকেয়া কোটির অঙ্ক ছুঁয়েছিল। এ ভাবে চলতে থাকলে তাদের পক্ষে অস্ত্রোপচার করা সম্ভব নয় বলে হাসপাতালগুলি জানানোয় চলতি মাসের মাঝামাঝি স্বাস্থ্য ভবনে একটি বৈঠকও ডাকা হয়। সেখানে হাসপাতালগুলি নিজেদের অপারগতার কথা জানানোর পরে চলতি সপ্তাহে তারা বকেয়া পেয়েছে। কিন্তু প্রতি বার টাকা আদায়ে এমনই সময় লাগবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে হাসপাতাল কর্তাদের একাংশ।
কী অবস্থা এসএসকেএম-এর? সেখানকার কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। কিন্তু পরিকাঠামো না বাড়ালে অস্ত্রোপচারের সংখ্যা বাড়া সম্ভব নয়। কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের প্রধান চিকিৎসক শুভঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “শুধু তো শিশুদের অস্ত্রোপচার করেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয় না, বড়দের অস্ত্রোপচারও তো হয়। তিনটি অপারেশন থিয়েটার। সেখানেই দিন-রাত কাজ চলছে। চতুর্থটি প্রস্তুত হয়ে পড়ে রয়েছে। হার্ট-লাং মেশিন এবং কর্মীর অভাবে সেটি চালু করা যাচ্ছে না। সেগুলির ব্যবস্থা হলেই শিশুদের অস্ত্রোপচার বাড়াতে পারব। মুখ্যমন্ত্রীর এই প্রকল্প সফল করতে আমরাও সমান ভাবে আগ্রহী।”
কবে পরিকাঠামো বাড়তে পারে এসএসকেএম হাসপাতালে? স্বাস্থ্যকর্তারা এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি। ‘শিশুসাথী’ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক পল্লব ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে যা বলার স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলবেন। যদিও স্বাস্থ্য-অধিকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ দিন কোনও কথা বলতে চাননি।
ফলে কলকাতা শহরের টুটুল চৌধুরী, বর্ধমানের তারক হালদার, পশ্চিম মেদিনীপুরের তানিয়া সামন্ত কিংবা মুর্শিদাবাদের শেখ জামিরের মতো অসংখ্য শিশু হৃদ্রোগীর অনিশ্চয়তা যে কবে কাটবে, তা বলার জন্যও এই মুহূর্তে কেউ নেই। এই সব শিশু রোগীদের বাবা-মায়েদের আক্ষেপ, এখন যেহেতু মাত্র চারটি হাসপাতালেই ‘শিশুসাথী’ প্রকল্প সীমাবদ্ধ রয়েছে, তাই তাঁরা অন্যত্র চেষ্টা করতে পারছেন না। পাঁচ বছরের টুটুলের মা মালতী চৌধুরীর কথায়, “দিন আনা দিন খাওয়া সংসারে মুখ্যমন্ত্রীর ওই প্রতিশ্রুতি সে সময়ে স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। কিন্তু এখন মেয়েটাকে বাঁচাতে পারব কি না, সেটাই বুঝতে পারছি না।” |