এ যেন দুশমনের প্রতীক্ষায় গা এলিয়ে বসে থাকা। শত্রু এসে হানা দিলে খানিক হাত-পা ছোড়া হবে ঠিকই, তবে ওটুকুই। শেষমেশ, নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে ক্যানসার প্রতিরোধের ছবিটা এমনই।
এই ফেব্রুয়ারিতে, বিশ্ব ক্যানসার দিবসের ঠিক প্রাক্কালে দিল্লির স্বাস্থ্য মন্ত্রককে পাঠানো হু-র রিপোর্টেই রয়েছে অশনি সঙ্কেতটি। রিপোর্টের সার বক্তব্য: যতটা ভাবা হচ্ছে, গোটা বিশ্বে ক্যানসার-পরিস্থিতি তার চেয়েও ভয়াবহ। ভারতে কার্যত তুঙ্গে। হু এ-ও বলেছে, সঙ্কটের সঙ্গে যুঝতে হলে নিছক চিকিৎসা পরিকাঠামো বাড়ালে হবে না। সর্বাগ্রে দরকার আঘাত হানার আগে ক্যানসারের হাল-হকিকৎ জেনে তাকে ঠেকিয়ে রাখার সুষ্ঠু পরিকল্পনা।
অর্থাৎ, যুদ্ধের ময়দানে ক্যানসার নামক শমনের আবির্ভাব ঘটুক চাই না-ঘটুক, আত্মরক্ষার ব্যূহ আগাম সাজিয়ে রাখা চাই। এবং ভারতীয় আমজনতার মনে সেই তাগিদটা গড়ে তুলতে সরকারি সদিচ্ছাই সবচেয়ে জরুরি বলে মন্তব্য করেছে হু। “ক্যানসারকে ঘায়েল করতে হলে সচেতনতার অস্ত্রকে যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করা ছাড়া উপায় নেই।’ বলছে রিপোর্ট। হু-র রিপোর্টটি স্বাস্থ্য মন্ত্রক বিভিন্ন রাজ্যকে পাঠিয়ে দিয়ে তৎপর থাকার পরামর্শ দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সচেতনতার বহর কেমন?
ছবিটা নিরাশাব্যঞ্জক বললেও খুব কম বলা হয়। রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের বড় অংশ মেনে নিয়েছেন, বেসরকারি বা সরকারি সচেতনতা গড়ে তোলার প্রয়াস কোনও স্তরেই তেমন নেই। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা, কেমোথেরাপি-রেডিওথেরাপি কিংবা অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতি বাড়ানোর বাইরে বিশেষ কিছু ভাবা হয় না। কী কী করা উচিত, খাদ্যাভ্যাস-জীবনশৈলীতে কী পরিবর্তন দরকার, তার প্রচার নেই। গোড়ায় রোগনির্ণয় সম্পর্কে গবেষণা বা সেমিনার-কর্মশালা আয়োজনেরও বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়ে না।
মানে, আসল অস্ত্রটাই ভোঁতা। এ দিকে হু-র ওয়ার্ল্ড ক্যানসার রিপোর্ট ২০১৪-র সহ সম্পাদক বার্নার্ড স্টুয়ার্ড লন্ডন থেকে জানিয়েছেন, “ভারতের মতো দেশে ক্যানসার স্ক্রিনিংই বেশি জরুরি। কোন ধরনের জীবনচর্যা রোগটা আনতে পারে, কী ভাবে মানুষ হুঁশিয়ার থাকবেন, কখন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, সে সব নিয়ে লাগাতার প্রচার চালিয়ে যেতে হবে।” হু’র দাবি, ৭০% ক্যানসারই প্রতিরোধযোগ্য। তার মধ্যে ৩০%-৪০% ক্যানসারকে আটকে দেওয়া যায় স্রেফ জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে।
সাধারণ মানুষ অবশ্য তা জানে না! জানিয়ে দেওয়ার চাড়ও নেই। কিন্তু ক্যানসার হয় কেন?
এখনও নির্দিষ্ট কিছুর দিকে আঙুল তোলা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য: জিনগত ব্যাপার একটা রয়েছে। পাশাপাশি ধূমপান, মদ্যপান, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতা, অসুরক্ষিত যৌনতা ইত্যাদির ভূমিকা থাকে। ক্যানসার-সার্জন গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “বায়ু-সহ পরিবেশের অন্যান্য দূষণ ও কিছু কিছু রাসায়নিকের প্রভাবও রোগ ডেকে আনতে পারে। হু ইতিমধ্যে বায়ু-দূষণকে ফুসফুস ক্যানসারের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিতও করেছে।” ক্যানসার-চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “অন্তত ৪০% ক্ষেত্রে ক্যানসারের জন্য দায়ী লাইফস্টাইল।” সেটা কী রকম?
আশিসবাবুর উদাহরণ, “মেয়েদের দেরিতে বিয়ে বা সন্তানকে স্তন্যপান না-করানোর সঙ্গে স্তন ক্যানসারের যোগ পাওয়া যাচ্ছে। অতিরিক্ত ওজন, জলপানে ঘাটতি, বেশি ফ্যাট খাওয়াও বিপজ্জনক। যেমন কোলন ক্যানসারের পিছনে রেড মিট অনেকাংশে দায়ী। বহু বছর ধরে কেউ যদি সপ্তাহে পাঁচশো গ্রামের বেশি রেড মিট খেয়ে যান, তাঁর কোলন ক্যানসারের ঝুঁকি অনেক বেশি। আবার অনেকক্ষণ খালিপেটে থাকার পরে হঠাৎ ফ্যাট জাতীয় খাবার খাওয়ার অভ্যেস থাকলে গল ব্লাডারে ও প্যাংক্রিয়াসে ক্যানসার হতে পারে।”
কিন্তু এ সব জানেন ক’জন? “সরকারি তরফে তো নয়ই, এমনকী আমরা ডাক্তাররাও ক্যানসারের সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসের যোগ নিয়ে কোনও প্রচার করি না।” স্বীকারোক্তি আশিসবাবুর। একই ভাবে ক্যানসারের জিনগত ঝুঁকি সম্পর্কেও প্রচার ভীষণ জরুরি। পরিবারে কারও (বাবা-মা তো বটেই, দাদু-ঠাকুমা, মাসি-পিসির মতো জেনেটিক সংযোগ থাকা যে কেউ) ক্যানসার হয়ে থাকলে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়, যা আরও বাড়ায় মদ্যপান বা ধূমপানের অভ্যেস।
অতি সহজ অথচ অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই তথ্যগুলো আমজনতার নজরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে যে দুর্বলতা রয়েছে, স্বাস্থ্য-কর্তারা তা মেনে নিচ্ছেন। “আমরা চেয়েছি, মফস্সলের মানুষও যথাযথ চিকিৎসা-পরিষেবা পান। নিখরচায় কেমোথেরাপির ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। আর এ সব করতে গিয়ে সচেতনতা প্রচারের দিকে তেমন খেয়াল রাখা হয়নি।” আক্ষেপ করেছেন স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা। কিন্তু পরিকাঠামো বৃদ্ধির যে দাবি ওঁরা করছেন, সে সবের কথাই বা জানেন ক’জন? জরায়ু-মুখ (সার্ভিক্যাল) ক্যানসার ধরা পড়ে যে ‘প্যাপ স্মেয়ার’ পরীক্ষায়, মেডিক্যাল কলেজগুলোয় তো বিনা পয়সায় তা করানোর ব্যবস্থা রয়েছে। তবু ক’জন মহিলা টেস্ট করাতে আসেন?
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “গ্রামের গরিবঘরের মেয়েদের কাছে ক্যানসার টেস্টের জন্য হাসপাতালে যাওয়া মানে গাড়ি-ভাড়ার খরচ, হয়তো বা এক দিনের রোজগারে দাঁড়ি।” তাঁর প্রস্তাব: বন্ধ্যত্বকরণের হার বাড়াতে সরকার যে রকম উৎসাহভাতা চালু করেছে, ক্যানসার স্ক্রিনিংয়েও তেমন ইনসেনটিভ দেওয়া হোক। তা হলে গ্রাম-গঞ্জের মেয়েদের আরও বেশি সংখ্যয় হাসপাতালমুখো করা যাবে বলে সুবীরবাবুর আশা।
“মনে রাখতে হবে, ক্যানসার ক্রমশ একটা জাতীয় সমস্যার চেহারা নিতে চলেছে। মোকাবিলাটাও সে ভাবেই করা চাই।” হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন ওই চিকিৎসক।
(চলবে) |
বিশ্ব জুড়েই তার করাল থাবা। আর ভারতে ক্রমশ মহামারির চেহারা ধরছে যে রোগ, সেই ক্যানসার প্রতিরোধের মাস হিসেবে চিহ্নিত ছিল এ বছরের ফেব্রুয়ারি। প্রতিরোধের ভিত কতটা মজবুত? উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার। |
বছরের শিকার |
কোথায় নতুন রোগী মৃত্যু |
• পশ্চিমবঙ্গ ৭০ হাজার ৩৩ হাজার
• ভারত ১০ লক্ষ ৪ লক্ষ
• বিশ্বে দেড় কোটি ৮০ লক্ষ |
সব হিসেব আনুমানিক
সূত্র- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা |
|