তখনও ভাল করে আলো ফোটেনি।
কয়েকশো কোদাল-ঝুড়ি নিয়ে মাটি কাটা শুরু হয়ে গিয়েছে। ট্রাক্টরের সঙ্গে থাকা ট্রলিতে চেপে তা পাচার হয়ে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার ভোরে অগ্রদ্বীপ ভাগীরথীর পাড়ে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্যই দেখলেন কাটোয়ায় সদ্য আসা মহকুমাশাসক মৃদুল হালদার। মহকুমাশাসক ও তাঁর দেহরক্ষীকে দেখার পরেও বেশ কিছু সময় ধরে মাটি কাটা চলে। ট্রলি সমেত ট্রাক্টরগুলো অবশ্য তখনকার মতো সরে পড়ে।
দেখেশুনে গাড়িতে বসে মহকুমাশাসক বলেই ফেলেন, “আমি চলে গেলেই আবার মাটি কাটা হবে। কাটোয়ায় ফিরে গিয়ে দেখি, এখানে পুলিশ ক্যাম্প বসানোর ব্যবস্থা করা যায় কি না। নিদেনপক্ষে নিয়মিত পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করতেই হবে।” অগ্রদ্বীপে এই ভাগীরথীর দুই পাড়ের মানুষ বহু বছর ধরে দেখে আসছেন। মাটি-মাফিয়াদের ভয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করার সাহস না পেলেও বিভিন্ন সময়ে নামে-বেনামে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে চিঠি দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু ওই পর্যন্তই! বছরে এক-আধবার হইচই হয়, তার পর যে কে সেই!
বুধবারই বর্ধমানে এসে রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে গিয়েছেন, নদী থেকে অবৈধ ভাবে বালি তোলা রুখতে কড়া আইন আনতে চাইছে রাজ্য। অবৈধ ভাবে মাটি কাটাও যে তার আওতায় পড়বে, তা এক রকম প্রত্যাশিত। কিন্তু মন্ত্রী ও কথা বলে যাওয়ার পরের দিনও মাফিয়াদের ভ্রূক্ষেপ নেই। কাজেই সাধারণ মানুষও ভয়ে চুপ। এক জন তো মহকুমাশাসককে বলেই দেন, “মুখ খুললেই রাতে বাড়িতে বোমা পড়বে। তখন কে দেখবে?”
বেআইনি ভাবে মাটি কাটতে নামা কয়েক জন মজুর আবার উঠে এসে মহকুমাশাসককে বলেন, “স্যার, এক দিন এসে আমাদের রোজগারটা মাটি করলেন। অথচ দিনের পর দিন যে এলাকা জুড়ে যন্ত্র দিয়ে মাটি কাটা চলছে, সে দিকে কারও নজর নেই।” |
স্থানীয় বাসিন্দাদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, কাটোয়া ২ ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক (বিএলএলআরও) এলাকায় আসেন, কিন্তু মাটি চুরি তাঁর নজরে পড়ে না। রাজনৈতিক দলগুলির ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
মহকুমা প্রশাসন সূত্রের খবর, কাটোয়া ২ ব্লকে ব্যাঙের ছাতার মত বহু ইটভাটা গজিয়ে উঠেছে। যার অধিকাংশই বেআইনি। রাতের অন্ধকারে মাটি কেটে কাটোয়া ২ ও পূর্বস্থলী ২ ব্লকের অনেক ভাটায় পাচার করা হয়। এ দিন সকালে নদীর পূর্বপাড়ে চরবিষ্ণুপুর গ্রামের দিকে প্রায় ৩০ বিঘা সরকারি জমি দখল করে মাটি কাটার কাজ চলছিল। কোথাও ৪ ফুট, কোথাও ৫ ফুট গর্ত করা হয়েছে। মাটি কাটার জায়গা থেকে নদীর দূরত্ব মেরেকেটে ৪-৫ ফুট।
স্থানীয় সূত্রের খবর, শুধু চরবিষ্ণুপুর নয়, পাশের কবিরাজপুর, কালিকাপুর, গাজিপুর এলাকাতেও নিয়মিত মাটি চুরি চলছে। তাতে যুক্ত মজুরেরা জানান, ট্রাক্টর মালিকদের হয়ে কাজ করে তাঁরা গড়ে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পান। ইটভাটার মরসুমে পুরো এলাকা জুড়ে প্রায় আড়াইশো ট্রাক্টর দিনে ৮-১০ বার মাটি বওয়ানোর কাজ করে।
এই সব ট্রাক্টরের মালিক কারা? কাদের মদতে তারা মাটি লুঠ করছে?
বিএলএলআরও দফতরের রিপোর্ট অনুযায়ী, ইটভাটা মালিকরা এলাকার ‘দাদা’ গোছের দুষ্কৃতীদের জমি দখল নেওয়ার কাজে নামান। তারাই ট্রাক্টর ও শ্রমিক নামিয়ে মাটি কেটে করে ভাটায় দিয়ে আসে। চরবিষ্ণুপুরের বেশ কয়েক জন বাসিন্দার আক্ষেপ, “আমরা খাসজমিতে ফসল ফলাতাম। হঠাৎ কয়েক জন দুষ্কৃতী এসে বলল, ‘কাল থেকে এই জমি আমার। চাষ বন্ধ। ৩০ হাজার টাকা নিয়ে কেটে পড়।’ আমার মতো অনেকেই জমি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।” শুধু সরকারি জমি নয়। ব্যক্তিগত জমিও অনেকে মাটি-মাফিয়াদের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এমনই এক জনের বক্তব্য, “কিছু করার ছিল না। জমি না দিলে প্রাণ যেত। এর বাইরে কিছু বলব না। একটা কথা জেনে রাখুন, ওই জমিতেই আমি এখন মাটি কাটছি।” বছরখানেক আগেই রাজ্যের ভূমি সচিব তপন সোম ভাগীরথীর পাড়ে মাটি কাটা বন্ধ করার জন্য বর্ধমান জেলার ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরকে চিঠি দিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য লাভের লাভ কিছু হয়নি।
মহকুমাশাসক বলেন, “এ ব্যাপারে কাটোয়া ২ বিএলএলআরও-র কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করা হবে।” বিএলএলআরও অরিন্দম চক্রবর্তী আবার দাবি করেন, “আমরা অভিযানে যাই, কিন্তু কারও দেখা মেলে না। অদ্ভুত ভাবে আগেই সবাই অভিযানের কথা জেনে যায়। তবে কোন কোন এলাকা থেকে মাটি চুরি হয়, ম্যাপ-সহ তার বিস্তারিত রিপোর্ট ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের কাছে পাঠানো আছে।” সিপিএমের কাটোয়া জোনাল সম্পাদক অঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, শাসকদলের একাংশের মদতেই মাটি-মাফিয়াদের রমরমা। ভাগীরথীর পাড় থেকে লাগাতার মাটি কাটা চলায় ব্লকের বিস্তীর্ণ এলাকা সঙ্কটে। অগ্রদ্বীপ গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান নিতাই মুখোপাধ্যায় অবশ্য তা মানতে চাননি। তাঁর দাবি, “এখানে দলের কোনও ব্যাপার নেই। সিপিএম নেতারাও জড়িয়ে আছেন। আমরা প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে এলাকাবাসীকে সচেতন করার চেষ্টা চালাব।” মহকুমাশাসক জানান, সাধারণ মানুষকে সচেতন করার জন্য পঞ্চায়েতকে বলা হয়েছে। |