গামছা, কঙ্কণা, নতুন অঙ্ক

সলমন খান, অক্ষয় কুমার গলায় গামছা জড়ানোর পরেই এ বার কঙ্কণা সেন শর্মার গলায়ও গামছা। এটা কি স্টাইল না কিষেণজির মেটাফর?
দুটোই। আমি আশ্চর্য হব না, যদি গৌতম কুণ্ডুুর রোজ ভ্যালির প্রযোজনায় ‘শূন্য অঙ্ক’ ছবিটি রিলিজ করার পরে কলকাতার কলেজ পড়ুয়ারা কোকোর মতো করে গামছা গলায় দেয় ফ্যাশনের খাতিরে। হিন্দি ছবিতে হিরোরা গামছাটা তো সেই দিলীপ কুমারের আমল থেকেই পরছেন। এখন সলমন আর অক্ষয়কেও দেখেছি গামছা গলায়। তবে আমার ছবিতে কোকোর গামছা গলায় দেওয়ার আর একটা কারণ আছে। এক জন সাংবাদিক যখন গ্রামে গিয়ে রিপোর্টিং করে, তখন ওটা থাকলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে খুব সুন্দর ভাবে মিশে যাওয়া যায়। আমার মনে আছে যখন আমি আর খুকু (গৌতম ঘোষের স্ত্রী) লিভ ইন করতাম, তখন ও গ্রামে আমার সঙ্গে শ্যুট করতে গেলে প্রায়ই শাড়ি পড়ত।

আপনি লিভ ইন করতেন?
হ্যাঁ। তিন বছর। আমার ছেলেমেয়েরা তো বিশ্বাসই করে না সেটা। তখনকার দিনে আমাদের লিভ ইন বেশ ঝড় তুলেছিল। খুকু আর আমি দু’জনেই তখন হিপি ধরনের। সবেমাত্র ‘ মাভূমি’ বানিয়েছি। ১৯৭৮ সাল হবে। তিন বছর ঘুরে ঘুরে শ্যুট করতাম। খুকু তখন জিন্স পরত। কিন্তু শ্যুটিঙের সময় দেখতাম শাড়ি পরে নিত। তাতে লোকালদের সঙ্গে মিশে যেত। আমাদের দেশের অনেক রাজনীতিকও অনেক সময় এ ভাবেই পোশাক-আশাক পরেন। অক্সফোর্ডে নেহরু পরতেন স্যুট। কিন্তু ভারতে ফিরে গ্রামে গেলেই কুর্তা। আমি লেখিকা অরুন্ধতী রায়ের একটা ছবি দেখছিলাম গামছা গলায়। তখন ও সাংবাদিকতা করতে গিয়েছিল দণ্ডকারণ্যে। সেই ছবিটা কিছুটা কঙ্কণার লুকের অনুপ্রেরণা। অরুন্ধতীর চোখে সানগ্লাস, আর গলায় গামছা ছিল।

কোকো কি মা হওয়ার পরে অভিনেত্রী হিসেবে আরও পরিণত?
খুব রিহার্সাল করে ও সেটে আসে।
ও যখন ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আয়ার’ ছবিটি করে, তখন আমি সিনেমাটোগ্রাফার। আমি শ্যুট করতে করতে বুঝতে পারি যে কোকো ইনটেন্স অ্যাক্টর। ও কিছু জায়গাতে ঠিক শাবানার মতন। দু’ জনেই টেকনিক্যালি ভীষণ ভাল। তবে কঙ্কণা মাঝে মাঝে একটা আদুরে বেবি হয়ে যায় সেটে। ভীষণ ভিতু! একটা সিন আছে যেখানে ওকে নেমে গিয়ে এক পাল গরুর মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হয়। সে কী ভয় ওর! তবে কোকোর গুণ হল ওর মধ্যে একটা কুণ্ঠা কাজ করে। অনেকটা নাসিরউদ্দিন শাহের মতো।

কুণ্ঠা কেন?
‘পার’ করার সময় মনে আছে, প্রত্যেক শটের পরে নাসির আমাকে চোখ দিয়ে ইশারা করে জিজ্ঞেস করতেন ঠিক হয়েছে কি না। এই কুণ্ঠাবোধ একটা বড় অভিনেতার লক্ষণ। স্টারদের মধ্যে এটা থাকে না। যে কোনও চরিত্রে সব থেকে ভাল অভিনয় করে সেই ছবির পরিচালক। কারণ চরিত্রটি তাঁর সৃষ্টি। এক জন ভাল পরিচালকের দায়িত্ব হল একজন অভিনেতাকে সেই জায়গাতে পৌঁছনোতে সাহায্য করা। অনেক ক্ষেত্রে ৯০% সেটা সম্ভব হয়। অনেক ক্ষেত্রে আবার সেটা হয় না। আমার এই ছবিতে কোকো সংবেদনশীল। প্রিয়ংকা বসু ইনস্টিংক্টিভ। প্রিয়াংশু চট্টোপাধ্যায় সেরিব্রাল। অরিজিৎ দত্ত অভিনেতা হিসেবে বেশ শক্তিশালী। ললিতা চট্টোপাধ্যায় ছাড়া ওই রকম ডিগনিফায়েড চরিত্রে আমি আর কাউকে ভাবতে পারি না। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো ডিরেক্টর’স অ্যাক্টর খুব কম আছেন। আমার খুব ইচ্ছে ছিল একটা ছবি করার উত্তমকুমার আর সৌমিত্রদাকে নিয়ে। সব ঠিকও ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারিনি।
হল না কেন?
ঠিক করেছিলাম প্রথম বাংলা ছবি করব সমরেশ বসুর গল্প নিয়ে। নাম ‘শ্রীমতী কাফে’। গল্পটা একটা কাফে আর একটা পরিবারকে নিয়ে। বিভিন্ন ধরনের মানুষ আসেন কাফেতে। তাঁদের মধ্যে দিয়ে একটা সময়কে ধরতে চাওয়া। ১৯২২ থেকে ১৯৪২ পর্যন্ত। কাস্টে উত্তমকুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, উৎপল দত্ত আর মমতাশঙ্কর। উত্তমকুমার কাফের মালিকের চরিত্রে। নাম ভজুলাঠ। সৌমিত্রদার নারায়ণ বলে একটা চরিত্র করার কথা ছিল। আমি কলকাতার বাইরে ছিলাম ‘মাভূমি’র একশো দিনের সেলিব্রেশনে। মাকে জন্মদিনে উইশ করার জন্য ফোন করতে গিয়ে শুনলাম যে উত্তমদা চলে গিয়েছেন। নিমেষের মধ্যে আমার প্রথম বাংলা ছবির প্ল্যানটা ভেস্তে গেল। ভেবেছিলাম ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়কে দিয়ে ভজুলাঠ করাব। তবে নানা কারণে হয়নি। ‘শূন্য অঙ্ক’তে সৌমিত্রদা আর ধৃতিমানদা দু’জনেই একসঙ্গে। সেটা বড় প্রাপ্তি। কাজ করতে করতে কত গল্প করেন সৌমিত্রদা। ‘দেখা’তে এক জন দৃষ্টিহীনের চরিত্র করে সৌমিত্রদা আমাকে বলেছিলেন, “গৌতম, আমি অস্কার পেয়ে গিয়েছি।”

এত বড় কমপ্লিমেন্ট?
একজন দৃষ্টিহীন ভদ্রলোক ওঁকে বলেছেন, “আপনার ‘দেখা’ দেখেছি। আমরা যে ভাবে দেখি, সে ভাবেই দেখেছি। ভাল লেগেছে। আমার স্ত্রী দৃষ্টিহীন নন। উনিও বলেছেন যে আপনি একদম ঠিক করেছেন।” এই কমপ্লিমেন্টটাই সৌমিত্রদার কাছে অস্কার। ‘শূন্য অঙ্ক’ করতে গিয়ে বলেন কোনও কিছুই ফেলা যায় না। “সেই কবে তপন সিংহের ছবিতে হুইল চেয়ারে বসা প্র্যাক্টিস করেছিলাম। আজ আবার তোমার ছবিতে সেটা কাজে লেগে গেল।”

ছবিতে হেমিংওয়ের একটা লাইন আছে, “আ ম্যান ক্যান বি ডেস্ট্রয়েড, বাট নেভার ডিফিটেড’। আপনার নিজের জীবনেও কি এটা প্রযোজ্য?
হ্যাঁ। যখন ছবি সে ভাবে চলেনি তখন মনে হয়েছিল আমি ডেস্ট্রয়েড। ‘পতঙ্গ’ করে শাবানা বিদেশে অনেক পুরস্কার পেয়েছিল। কিন্তু ছবিটি দেশে নমো নমো করে মুক্তি পায়। প্রোডিউসারের বাবার ভয় ছিল ছবির চরিত্রগুলোর সঙ্গে বাস্তবের অনেক মিল থাকায় অসুবিধে হতে পারে। খারাপ লাগলেও, হাল ছাড়িনি। প্রোডিউসার যদি একটি ছবির বাবা হন, পরিচালক তার মা। একটা ছবি বানাতে দশ মাস লাগে। পরিচালককেও প্রসব যন্ত্রণা পেতে হয়।

ছবিতে রেড করিডর নিয়ে উল্লেখ থাকলেও, আপনি স্ট্যান্ড নেননি...
শিল্পীর কাজ একটা আয়না তুলে ধরা। ফিকশনের মজাই এখানে দর্শককে নাড়া দেবে। শিল্পী নিজের মতটা চাপিয়ে দেবে না। শ্যুটিংয়ের পরে কোকো আমাকে বলেছিল: “আমি চাই এমন একটা এডুকেশন সিস্টেম যেখানে বাচ্চারা বাধ্যতামূলক ভাবে তাদের দেশকে দেখতে শিখবে। আমি যে ভাবে এই ছবি করে দেশকে চিনেছি ঠিক সে ভাবেই।” শাবানাও একই কথা বলেছিল ‘পার’ করে। কাইফি আজমির মেয়ে তবু বলেছিল ছবি করার পরে ও দেশকে নতুন ভাবে চিনতে শিখেছে।

ভয় পেয়েছিলেন স্ট্যান্ড নিতে?
ভয় করলে ছবি করা যায় না। আমার গুরু রোবার্তো রোসিলিনি বলতেন। আমার বিশ্বাস কোনও কনফ্লিক্ট-এর মধ্যে দিয়ে একটা দেশ এগোতে পারে না। ‘শূন্য অঙ্ক’ একটা দেশপ্রেমের ছবি। দেশপ্রেম মানে কিন্তু শুধুমাত্র কার্গিল যুদ্ধে গান গাওয়া নয়। আমরা এমন একটা ভারতবর্ষে বাস করি যেখানে অনেক বৈচিত্র আছে। সাদা কালোতে ভাগ করা যায় না। শিল্পায়ন চাই তবে গ্রামবাসীদের কথাও ভাবতে হবে। ছবিটা মিডিয়ার সেলিব্রেশন। ছবিটি ভারত আর বিদেশে একই সঙ্গে ১৮ জানুয়ারি মুক্তি পাচ্ছে। নানা ভাষার সংলাপ রয়েছে ছবিতে। এর বিষয় সর্বভারতীয় স্তরে প্রযোজ্য।
তবে আগেকার দিনের পরিচালকেরা কিন্তু একটা ক্লিয়ার পলিটিক্যাল স্ট্যান্ড নিতেন। সেটা কি পাল্টেছে?
না, সে ভাবে পাল্টায়নি। ‘পার’ এর সাফল্যের পরে মানিকদা বলেছিলেন, “এ বার মুম্বই থেকে অনেক অফার আসবে। অবশ্যই করবে। তবে ভেবেচিন্তে।” আর মৃণালদা বলেছিলেন, “তুমি যেটা তৈরি করছ, সেটা একটা প্রোডাক্ট। তার একটা মার্কেট আছে। তবে মার্কেট যা বলছে তাই সব সময় কোরো না। মনে রেখো তোমার নিজের ছবিও একটা মার্কেট তৈরি করতে পারে।” তার জন্য প্রয়োজন ছবিতে রাজ্য সরকারের বিনিয়োগ। মানিকদা, মৃণালদা, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত আর আমি অনেক ছবি বানিয়েছি সে ভাবে। তবে সেগুলো কোনওটাই প্রো-স্টেট ছবি নয়। যেমন ‘গণশত্রু’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘হীরক রাজার দেশে’ আর ‘পরশুরাম’। এখনকার পরিচালকরা সরকারের এই সাহায্যটা পেলে আরও সাহসী কাজ করতে পারবে। তবে সবচেয়ে বেশি দরকার পশুদের নিয়ে ছবিতে যে আইন আছে তার সংশোধন।

কী ভাবে?
ছবিতে পশুকে নিয়ে শ্যুটিং করতে গেলে কত নিষেধাজ্ঞা! তবে কসাইখানাগুলো তো কেউ বন্ধ করে না। আর ধূমপানের দৃশ্য নিয়ে যে বাড়াবাড়িটা চলছে, সেটা দেশের সবচেয়ে বড় ভণ্ডামি। সিগারেট কোম্পানিগুলো থেকে প্রচুর শুল্ক পায় সরকার। তাই ওগুলো বন্ধ করার কথা কেউ বলে না। বিদেশের ফেস্টিভ্যালে ছবি পাঠালে ওরা আমাদের দেখে হাসবে। প্রত্যেকটা ধূমপানের সিনেই সতর্র্কীকরণ। এটা পাল্টাতেই হবে। প্রয়োজনে আইনের পথ নিতে হবে।

গ্যুন্টার গ্রাসের সঙ্গে ডকুমেন্টারিটা কত দূর এগোল?
আমি আর শুভাপ্রসন্ন ওঁর গ্রামে গিয়েছিলাম। পঞ্চাশ বছর আগে ওঁর একটা লেখা রিপ্রিন্ট হচ্ছে। তার সঙ্গে উনি দেড়শোটা ইলাসট্রেশন করছেন। উনি এঁকেছেন, কথা বলেছেন, আর আমি শ্যুট করেছি। মাঝে মাঝে ক্যামেরার পেছন থেকে সামনে চলে এসেছি। আরও অন্যান্য শিল্পীকে নিয়েও একই ভাবে শ্যুট করতে চাই।

ইরফান আর প্রসেনজিৎ-কে নিয়ে ছবিটার কী হল?
কমলকুমার মজুমদারের গল্প নিয়ে প্ল্যান করেছিলাম। নাম ‘কয়েদখানা’। ইরফান আজও দেখা হলে জিজ্ঞেস করে ওটার কথা। তবে ওই ছবিটা করতে গেলেও অ্যানিম্যাল রাইটস-এর ঝামেলা হতে পারে। আমাদের দেশের যা অবস্থা, বাজেট থাকলেও আমরা হয়তো একটা ‘লাইফ অব পাই’ বানাতে পারব না।

জ্যোতি বসুর ওপর ডকুমেন্টারি বানিয়েছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও আপনাকে দেখা যায়। পরিচালক হতে গেলে কি ডিপ্লোম্যাটিক হওয়া দরকার?
না। জ্যোতিবাবু একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ছিলেন। এবং ডকুমেন্টারিতে নিজের পার্টির সমালোচনাও করেছেন। আপস করলে ডিরেক্টর হওয়া যায় না।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.