অকৃতকার্য ছাত্রীদের পাশ করাইবার দাবিতে কলিকাতার একটি বালিকা বিদ্যাপীঠের ছাত্রীরা শিক্ষিকাদের বাইশ ঘণ্টা ঘেরাও করিয়া পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্রে যে-অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করিয়াছেন, অনুরূপ নজির সৃষ্টি করিলেন উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের কর্তৃপক্ষও। তাঁহারা বিক্ষোভরত ছাত্রীদের অন্যায় ও অনৈতিক দাবি শিরোধার্য করিয়া নূতন করিয়া পরীক্ষাগ্রহণের ফরমানই জারি করিয়া বসিলেন। পরে বেগতিক দেখিয়া তাঁহারা অন্য সুর গাহিতেছেন বটে, কিন্তু সুর মোটেই লাগিতেছে না। পড়ুয়াদের বিক্ষোভে ফেল-করা ছাত্রীদের অভিভাবকরাও শামিল ছিলেন। নেপথ্যে কিংবা প্রকাশ্যে হয়তো শাসক রাজনৈতিক দলের ছোট-মেজ-সেজ স্থানীয় নেতারাও। উসকানি বা প্ররোচনা যাহাদেরই থাক, বালিকা বিদ্যাপীঠের দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হইতে অন্যান্য স্কুলের ফেল-করা পড়ুয়া ও অভিভাবকদের বিলম্ব হয় নাই। পত্রপাঠ বেহালার একটি স্কুলেও টেস্ট পরীক্ষায় ফেল-করা ছাত্ররা পাশ করাইবার দাবি তুলিতে শুরু করে। শিক্ষকদের সঙ্গে হাতাহাতিও হয়। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাক্ষেত্র কি সত্তরের দশকের নৈরাজ্যের পুনরাবৃত্তির জন্য প্রস্তুত?
গত শতাব্দীর সেই নৈরাজ্যের পিছনেও রাজনীতিই কারণ ছিল। তবে সেটা ছিল উগ্রপন্থী রাজনীতি। বর্তমানে রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্রে যাহা চলিতেছে, তাহা হইল ‘দখলে রাখা’র রাজনীতি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে অনিল বিশ্বাসের নেতৃত্বে রাজ্যের সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাটি সি পি আই এম-এর সদর দফতর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট হইতে নিয়ন্ত্রিত হইত। সরকারের পরিবর্তন সেই প্রবণতায় কোনও পরিবর্তন সূচিত করে নাই। কেবল বিশৃঙ্খলা বাড়িয়াছে। সত্তরের দশকেও টুকিয়া পাশ করিতে দিবার দাবিতে কোনও-কোনও কলেজে (যেমন আইন কলেজে) প্রকাশ্যে ছাত্র ইউনিয়ন পেশিশক্তি প্রদর্শন করিত। বর্তমান জমানাতেও পরীক্ষার হলে নকল করার অধিকার প্রকাশ্যেই দাবি করা শুরু হইয়াছে। অকৃতকার্যদের পাশ করাইবার দাবি তাহারই সম্প্রসারণ।
ডিগ্রির মোহ পড়ুয়ামাত্রেরই আছে। যে কোনও প্রকারে পরীক্ষায় পাশ করা তাই আবশ্যিক। সে জন্য যদি একাধিক বার পরীক্ষাগ্রহণ করিতে হয়, তথাস্তু। মুশ্কিল হইল, টেস্ট পরীক্ষায় তো ডিগ্রি মেলে না, টেস্টে পাশ করাইয়া দিলেও উচ্চ মাধ্যমিকের চৌকাঠটি এই পড়ুয়ারা কেমন করিয়া ডিঙাইবে? তবে কি টেস্ট-পরীক্ষার গেরোটাই তুলিয়া দেওয়া হইবে? না কি শিক্ষামন্ত্রী অতঃপর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদকে সহজ প্রশ্ন করিয়া ততোধিক উদার ভাবে নম্বর দিবার নির্দেশ দিয়া সকলকে পাশ করাইবার ব্যবস্থা করিবেন? তাহাতে অবশ্য অন্য একটি কৃতিত্বও অর্জন করা যাইবে। দেশের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে কৃতকার্যের সংখ্যা বা শতাংশের হারে পশ্চিমবঙ্গকে শীর্ষস্থানের দাবিদার করা যাইবে। তবে তাহাতে স্কুলশিক্ষার যেটুকু অবশিষ্ট রহিয়াছে, তাহার সম্যক বারোটা বাজিবে এবং দেশের মেধাসম্পদ আহরণকারীরা আর পারতপক্ষে রাজমহল পাহাড়ের পূর্বে পা রাখিবেন না। |