কানেক্টিকাট-এর নিউটাউন নামক শান্ত শহরটির স্কুলে একক বন্দুকধারীর আক্রমণে কুড়িটি শিশু সহ ছাব্বিশ জনের মৃত্যুর পরে নিউ ইয়র্কের মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ মন্তব্য করিয়াছেন, এই ধরনের হিংস্র ঘটনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি ‘জাতীয় মহামারি’তে পরিণত হইয়াছে। একক আততায়ীর আক্রমণে বহু মানুষ প্রাণ হারাইতেছেন, বিশেষত স্কুলের মতো অরক্ষিত স্থানে, এমন ঘটনা ‘উন্নত’ দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও সম্পূর্ণ বিরল নয়। কিন্তু এই বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাস্তবিকই অ-তুলনীয়। বারাক ওবামা যখন বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসাবে তিনি চার বার এমন ঘটনার সম্মুখীন হইলেন, তখন তাঁহার উচ্চারণে সেই অনন্যতাই প্রতিফলিত হয়। এবং তাহার পাশাপাশি অনিবার্য ভাবে আসিয়া পড়ে আর এক অনন্যতা। ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্রের মালিকানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধারেকাছে কেহ নাই। একটি হিসাবে দেশের অর্ধেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের বাড়িতে অন্তত একটি বন্দুক আছে। অধিকাংশ বন্দুকধারী, অবশ্যই, পুরুষ। হাতে বন্দুক থাকিলেই কেহ অসহায় শিশুদের উপর চড়াও হইবে, তাহা নিশ্চয়ই নহে। কিন্তু অস্বাভাবিক রকমের বেশি মানুষের নাগালে যদি আগ্নেয়াস্ত্র থাকে, তাহা হইলে নিউটাউনের মতো ঘটনার সম্ভাবনা যে বাড়িয়া যায়, তাহা বুঝিবার জন্য সম্ভাব্যতার তত্ত্বে উচ্চশিক্ষা লইবার প্রয়োজন হয় না। অ্যাডাম ল্যানজা নামক তরুণটির উদ্দেশ্য বা মানসিকতা তদন্তসাপেক্ষ, কিন্তু কিছু মাত্র তদন্ত না করিয়াই বলা যায়, তাহার হাতে বন্দুকটি না থাকিলে তাহার দেশ ও দুনিয়া এই দৃশ্য হইতে রক্ষা পাইত।
সমস্যা ইহাই যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ব্যক্তিগত আগ্নেয়াস্ত্র রাখিবার অধিকার একটি ‘ঐতিহাসিক’ অধিকার হিসাবেই গণ্য। বিপুলায়তন এক অজ্ঞাত মহাদেশে আসিয়া ইউরোপের যে অভিবাসীরা ক্রমে আপন বাসভূমি ও আধিপত্য বিস্তার করিয়াছিলেন, তাঁহাদের দিগ্বিজয়ে বন্দুকের ভূমিকা ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আত্মরক্ষা, পশু শিকার, আদিবাসীদের নির্মূল করিয়া আপন সাম্রাজ্য প্রসার বিবিধ উদ্দেশ্য সাধনেই আগ্নেয়াস্ত্রের বিকল্প ছিল না। উদ্দেশ্যগুলির মধ্যবর্তী সীমারেখাও বোধহয় সে কালে ঈষৎ অস্পষ্ট আমেরিকান ইন্ডিয়ানরাও তো শ্বেতাঙ্গদের ‘শিকার’ই হইয়াছিল! পরবর্তী পর্বে এই পরিপ্রেক্ষিতের সহিত যুক্ত হয় বর্ণবৈষম্য এবং বর্ণবিদ্বেষ, বন্দুক হইয়া দাঁড়ায় সেই তীব্র বিভাজনের পরিমণ্ডলে আক্রমণ ও আত্মরক্ষার অস্ত্র। কিন্তু এই ইতিহাসের সহিত জড়াইয়া যায় ব্যক্তিস্বাধীনতার বিশেষ ভাবে মার্কিন ধারণা, যে ধারণায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হইতে ব্যক্তির অধিকারকে যথাসম্ভব মুক্ত রাখার দাবি মহামূল্যবান। সংবিধানের ‘দ্বিতীয় সংশোধনী’তে নিজস্ব আগ্নেয়াস্ত্রের অধিকারের স্বীকৃতি এই সত্যেরই পরিচয় বহন করিতেছে।
আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কথা উঠিলেই প্রধানত দুই ধরনের যুক্তিতে বাধা দেওয়া হয়: তাত্ত্বিক এবং বাস্তবিক। তাত্ত্বিক যুক্তিটি উপরোক্ত ব্যক্তিস্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারের যুক্তি। কিন্তু সেই যুক্তি, কিংবা অজুহাত, ব্যবহার করিয়াই যে বাধাটি প্রবল আকার ধারণ করে, তাহা রাজনৈতিক, যে রাজনীতির পিছনে আবার অর্থনীতির দীর্ঘ ছায়া। সহজ সত্য ইহাই যে, মার্কিন রাজনীতিতে, বিশেষত রিপাবলিকান দলের উপর দেশের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবসায়ীদের প্রভাব বিপুল। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ন্ত্রণের নানা প্রস্তাব আইনসভার বৈতরণীতে কার্যত নামিতেই পারে নাই, পার হওয়া দূরস্থান। নিউটাউন কাণ্ডের পরে ওবামা এই বিষয়ে ‘যথাশক্তি’ চেষ্টা করিবার প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন। কত দূর পারিবেন? বিল ক্লিন্টন ১৯৯৪ সালে বন্দুকের উপর আংশিক নিয়ন্ত্রণ জারি করিবার ফলে ডেমোক্র্যাট দলকে রাজনৈতিক মাশুল গনিতে হইয়াছিল। ওবামা প্রয়োজনে নিজের ও দলের স্বার্থ বাজি ধরিতে পারেন, স্বাস্থ্য সংস্কারের প্রশ্নে তাহার প্রমাণ প্রথম দফায় দিয়াছেন। বন্দুক নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে যদি তিনি সাহসী হইতে চাহেন, ইহাই শ্রেষ্ঠ সময়। হয়তো জনপ্রতিনিধিদের একটি বড় অংশকে সঙ্গী পাইবেন। নিউটাউন বন্দুকপন্থীদের একাংশকে নূতন করিয়া ভাবাইয়াছে। রাজনীতিকদের সুচেতনা কোনও দেশেই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। বিলম্ব করিলে ওবামা এই সুযোগও হারাইবেন। |