প্রবন্ধ...
শেষ পর্যন্ত দোষ হল কেবল বন্দুকের?
ডিসেম্বর ১৪, স্যান্ডি হুক জুনিয়র স্কুল, নিউ টাউন, কানেক্টিকাট। অটোম্যাটিক বন্দুক। অ্যাডাম ল্যানজা। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। মৃত্যু। ক্লাস ওয়ানের একমাত্র জীবিত বাচ্চাটি মেয়েটি মা-কে বলে: ‘আমি ঠিক আছি কিন্তু আমার বন্ধুরা সবাই মরে গেছে!’ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় এবং বাকি দুনিয়ায় মার্কিন বন্দুক-লবির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে ধর্না। ‘গান কন্ট্রোল’ সোশাল নেটওয়ার্কে এ-মুহূর্তে সবচেয়ে ব্যবহৃত শব্দ। ভার্জিনিয়া টেক ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে পাঁচ বছর আগে ৩২ জন ছাত্রছাত্রীর মৃত্যুর পর, সম্প্রতি কলোরাডোয় সিনেমা হলে ১২ জনের নিহত হওয়ার খবরেও সারা দুনিয়া নিন্দায় মুখর হয়েছিল, স্লোগান উঠেছিল: বন্দুক হটাও, আমেরিকা বাঁচাও। আমরাও সেই একই স্লোগান আউড়ে চলেছি মার্কিন ইতিহাসকে অস্বীকার করে। নাগরিক অধিকার, লবি, কন্ট্রোল এই শব্দগুলিকে সহজেই তালগোল পাকিয়ে সস্তা রাজনৈতিক বোলচালে ফেসবুক, টুইটার ভরাই আমরা। ফল: ন যযৌ ন তস্থৌ। অবাক হলাম একটি হেডলাইন দেখে: অ্যাডামের মায়ের বন্দুকপ্রীতিই নাকি সর্বনাশের মূল। প্রথম গুলিটা কিন্তু ওই ভদ্রমহিলার শরীরেই ঢুকেছে।
আমেরিকার স্বাধীনতা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে অর্জিত। যে কোনও মার্কিন নাগরিক তাঁর দেশ নিয়ে মোটামুটি গর্বিত, অন্তত স্বাধীনতার মূল স্তম্ভগুলি সম্পর্কে কারও দ্বিমত নেই। সংবিধানের দ্বিতীয় অ্যামেন্ডমেন্ট হয় ১৭৯১ সালে, যেখানে লেখা হয়, ব্যক্তিগত প্রয়োজনে যে কোনও নাগরিক অস্ত্র রাখতে পারবেন। সময়ের সঙ্গে অস্ত্রের সংজ্ঞাও বদলেছে হ্যান্ডগান থেকে অ্যাসল্ট রাইফেল। আত্মরক্ষা আর আক্রমণ দুটো কাজেই বন্দুক ব্যবহৃত হতে পারে। আক্রমণ বাড়ছে বলে আত্মরক্ষার উপায়টাও লোপাট করে দাও: কাজের কথা কি? শৈশবে রচনায় লিখতাম, বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ, তা নির্ভর করছে ব্যবহারকারীর উপর। এটাও তা-ই। কিছু লোক বন্দুকের ব্যবহার করছে জঘন্য ভাবে। তাই সবার বন্দুকই যদি কেড়ে নিতে হয়, সে যুক্তিতে ফিজিক্সের গবেষণা বন্ধ করে দেওয়া উচিত, পাছে কেউ অ্যাটম বোম বানিয়ে ফ্যালে!
ব্যক্তিগত। ইলিনয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ডিসেম্বর ২০১২।
এ বছর সে দেশে রেকর্ডসংখ্যক ব্যক্তিগত বন্দুক বিক্রয় হয়েছে।
কিছু পরিসংখ্যান দেখা যাক। আমেরিকার ৮৮% পূর্ণবয়স্কের বন্দুক আছে। পৃথিবীর ৪০% বন্দুক (ব্যক্তিগত লাইসেন্স) আমেরিকায়, অথচ জনসংখ্যা পৃথিবীর ৭% মাত্র। প্রথম বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে আমেরিকায় ‘গান ভায়োলেন্স’-এ মৃত্যুর সংখ্যা অন্তত ২০০% বেশি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, এ এক ভয়ঙ্কর দেশ, রাস্তায় বেরোলেই যখন তখন যে কেউ গুলি করে দেবে। কিন্ত বাস্তব পরিস্থিতি তো তা নয়। যে কোনও মৃত্যুই খুব মর্মান্তিক, বিশেষ করে ছ-সাত বছরের বাচ্চারা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল এ দৃশ্য কল্পনাতেও অসহনীয়, কিন্তু একটি বা কয়েকটি মর্মান্তিক ঘটনাকে একটা দেশের সাধারণ পরিস্থিতির সূচক হিসেবে ব্যবহার করাটা একটু বেশি নাটকীয়। এখন মূল আলোচ্য হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক অধিকার এবং অধিকারের অপব্যবহারের মধ্যে পার্থক্য।
আমেরিকায় গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত। এবং বাকি বিশ্বের জনগণ (বিশেষ করে তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের) সাধারণত সেই গণতন্ত্রের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ও দেশের রাস্তাঘাট, অফিস-কাছারি, গাড়ি-বাড়ি আমাদের পছন্দ এবং এক বার গিয়ে পড়লে ফিরে আসা খুব শক্ত। খোঁচ হয়ে উঠে আছে একটাই ব্যাপার যদি বন্দুকের ‘একুশে আইন’ বদলে দেওয়া যেত! সমস্যা হল, গণতন্ত্র আধাখেঁচড়া ঢঙে চলে না। তুমি গণতন্ত্রের ২৩টি পয়েন্ট নেবে আর ২৪তম-র বেলায় ‘এটা থাক’ বলে নাক সিঁটকে সরে যাবে, তা হয় না। যাঁরা ওবামাকে হোয়াইট হাউসে ফেরালেন, সেই জনগণেরই ৫৪% একটি সমীক্ষায় বলেছেন, তাঁরা চান বন্দুক সংক্রান্ত আইন অপরিবর্তিত থাকুক! ও দেশে প্রতিটি বিল বা তার সংশোধনী নিয়ে পার্লামেন্টে বিতর্ক হয়। আমাদের দেশের মতো বিরোধীশূন্য সভায় বিল পাশ করে নেওয়ার রেওয়াজ নেই বললেই চলে। ২০০৮ এবং ২০১০ সালে অস্ত্র আইন পরিবর্তনের কাজিয়া সুপ্রিম কোর্ট অবধি গড়ায় কিন্তু দু’বারই সেকেন্ড অ্যামেন্ডমেন্ট-এর জয় হয়। অর্থাৎ নাগরিক অধিকারের জয়। যে ৫৪% নাগরিক এতে উল্লসিত, তাঁদের মানসিকতা বোঝা কিন্তু দুরূহ নয়। বাড়িতে ছুরি-কাঁচি রাখার মতোই বন্দুক রাখাও এঁদের কাছে স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানে সরকারি সুরক্ষা সহজলভ্য নয়, আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিজে করাই দস্তুর। এটা আমেরিকার ক্ষেত্রে যেমন সত্যি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউরোপ, এমনকী আমাদের দেশের কিছু রাজ্যেও সত্যি। কোনও সুস্থ নাগরিক, যিনি অসম্ভব পরিশ্রম করে জীবিকা অর্জন করছেন, দেশের মানসম্মান বজায় রাখার জন্য রাস্তায় থুতু ফেলছেন না, যত্রতত্র প্রস্রাব করছেন না, বা নিয়ম মেনে গাড়ি চালাচ্ছেন সারা জীবন, তিনি একটা বন্দুক কিনবেন, আর রাগ হলেই গুলি ভরে রাস্তায় বেরিয়ে দুমদাম লোক মারতে শুরু করবেন, তা নিশ্চয় হতে পারে না। দায়িত্ববান, সচেতন নাগরিক নিজের বন্দুক যে ভাবে সামলে রাখবেন, একটি শিশুকেও সে ভাবে আগলাবেন ঝড়ঝাপটা থেকে। না হলে তো বন্দুকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকার জনসংখ্যা এত দিনে অর্ধেক হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। অস্ট্রেলিয়ার হিসেব: গত এক বছরে গান ভায়োলেন্সে যত মৃত্যু, তার দশ গুণ মৃত্যু হয়েছে হাইওয়ে অ্যাকসিডেন্টে। তা হলে কি গাড়ি চালানো বন্ধ হয়ে যাবে অস্ট্রেলিয়ায়? উত্তর খুঁজতে গেলে বন্দুকের নল আপনাআপনি ঘুরে যাবে সমাজের দিকে, পরিবারের দিকে, মানুষের অসহায়তার দিকে, সেই মুহূর্তের দিকে যখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয় বেঁচে থাকা অর্থহীন।
এক জন মানুষ মরতে চাইলে একা মরতে পারে অথবা অনেককে নিয়ে মরতে পারে। তার জন্য বন্দুককে দায়ী করলে ইট, কাঠ, পাথরকেও দায়ী করতে হয়। আমি যদি মরতে চাই এবং মরার আগে মারতে চাই তা হলে সাতসকালে হাওড়া ব্রিজ থেকে কয়েক জনকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে পারি অথবা এসপ্ল্যানেড মেট্রো স্টেশনে! যে মারছে, তার যা মানসিক অবস্থান, তার কাছে বাচ্চা, বুড়ো, ছেলে, মেয়ের কোনও তফাত নেই। আমেরিকায় গত এক বছরে ১৫-১৬টি গান ভায়োলেন্সের ঘটনা ঘটেছে। যেটা দরকার: কোন মানসিক অবস্থায় এই ক’জন হাতে-গোনা মার্কিন নাগরিক কাণ্ডগুলি ঘটালেন, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ। সেই পরিস্থিতি কী করে রোধ করা যায়, তার ভাবনা। সমাজের কোন খামতি থেকে এই মানসিকতা জন্মাচ্ছে, আলোচনা। এ-ও ভাবতে হবে, কেন এঁদের সবাই পুরুষ! তার বদলে, সর্বত্র শুনছি: বন্দুক বেচা বন্ধ করো, নিদেন অ্যাসল্ট রাইফেল বাজেয়াপ্ত করো যাতে কম লোক মরে। অর্থাৎ ধরেই নিচ্ছি, আর্থসামাজিক চাপে বা ড্রাগ ওভারডোজে উন্মাদ হয়ে কিছু লোক (পুরুষ) প্রতি বছর আত্মঘাতী হবে। প্রায় বছর পনেরো আগে, আমি নিউ ইয়র্কে কর্মরত। বিকেল নাগাদ খবর এল এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর স্কাই ডেক-এ জনৈক ব্যক্তি গুলি চালিয়ে দু’জনকে মেরে ফেলেছে। আমরা স্তম্ভিত। অফিসে ক্যাফেটেরিয়ায় দুই মার্কিন কলিগ, জন আর স্টুয়ার্ট-এর তুমুল তর্ক শুরু হল। গান লবির পক্ষে এবং বিপক্ষে। দু’জনেরই বাপ-ঠাকুরদা একাধিক বন্দুক সংগ্রহ করেছিলেন। জন সেগুলি ত্যাগ করেছে, স্টুয়ার্ট আরও ক’টা কিনেছে। তর্ক শেষ করে দু’জনে হ্যান্ডশেক করে উঠে গেল। এটাই আমেরিকান স্পিরিট। তোমার ইচ্ছে তুমি বন্দুক ফেলে দিয়েছ, আমার ইচ্ছে আমি নতুন কিনেছি। আমার ওপর কোনও আইন চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। আর চাপিয়ে দিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনেও হয় না, গণতন্ত্রের পতাকায় একটা ফুটো করে দেওয়া ছাড়া। আমেরিকায় বছরে লক্ষাধিক ধর্ষণ ঘটে। এদের মধ্যে ৯১% ধর্ষিত মহিলা, ৯৯% ধর্ষণকারী পুরুষ। ধর্ষণকারীদের রি-হ্যাবে পাঠানো হয়, ছাড়া পেয়ে কেউ কেউ আবার ধর্ষণ করেন। আজ যদি প্রেসিডেন্ট ওবামা একটি তালিবানি ফতোয়া জারি করেন যে, পুরুষ দেখামাত্র তার যৌনাঙ্গ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে, খুব লাভ হবে কি?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.