|
|
|
|
সপা-র সঙ্গে বেনজির বিরোধ, নির্ভরতায় সন্ধি |
ক্রুদ্ধ সনিয়া হাত চেপে রুখলেন বিল ছিনতাই
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
এক অন্য সনিয়া গাঁধী! লোকসভায় হল্লা করলে ইদানীং নিজ দলের সাংসদদেরও রেয়াত করেন না কংগ্রেস সভানেত্রী। কিন্তু লোকসভায় আজ যে রকম রণমূর্তিতে তাঁকে দেখা গেল, তাঁর ১৩ বছরের সংসদীয় জীবনে এমনটা কখনও দেখা যায়নি।
পদোন্নতিতে সংরক্ষণ বিল পেশ হওয়ার সময় সেটি পার্সোনেল দফতরের মন্ত্রী নারায়ণস্বামীর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিলেন সপা-র এক সাংসদ। কিন্তু ক্ষিপ্রতার সঙ্গে নিজের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর হাত চেপে ধরেন দৃশ্যতই ক্রুদ্ধ সনিয়া। বিলটি ছিঁড়তে বাধা দেন তাঁকে। নাটকীয় এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সপা-কংগ্রেস বচসায় যেমন সভা মুলতবি হয়ে যায়, তেমনই তা আজ সাড়া ফেলে দেয় রাজনীতির অলিন্দে।
সংসদে বিল ছেঁড়ার দৃষ্টান্ত বিরল নয়। অতীতে মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশের সময় লালু-মুলায়ম বাহিনী তা ছিঁড়েছিল। সম্প্রতি রাজ্যসভায় লোকপাল বিল নিয়ে আলোচনার সময় বিলটি নারায়ণ স্বামীর হাত থেকে কেড়ে ছিঁড়ে দেন আরজেডি সাংসদ রাজনীতি প্রসাদ। তবে সনিয়ার মতো উচ্চ রাজনৈতিক মর্যাদার কোনও রাজনীতিককে সরাসরি এ ভাবে রুখে দাঁড়াতে দেখা যায়নি।
ওই ঘটনার পরপরই কংগ্রেস-সপা পরস্পরের বিরুদ্ধে কিছুটা সুর চড়ালেও পরে উভয়েই নরম হয়ে যায়। দুই শিবিরের এই ভোলবদলের নেপথ্যে পারস্পরিক রাজনৈতিক নির্ভরতার ছবিটাই যেন স্পষ্ট। তবে রাজনীতি যা-ই থাকুক, আবেগ-উত্তেজনা উত্তেজনা প্রকাশে বরাবরই সংযত সনিয়া এ দিন যে ভাবে সংসদের মর্যাদা রক্ষায় সক্রিয় ভাবে এগিয়ে এলেন, সেটা সভায় উপস্থিত অনেকের কাছেই স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে।
পদোন্নতিতে তফসিলিদের জন্য সংরক্ষণের বিলটির বিরোধিতায় এ দিন সকাল থেকেই হট্টগোল শুরু করেন সপা সাংসদরা। তাঁদের হল্লায় লোকসভা দফায় দফায় মুলতবি হয়ে যায়। তিনটে নাগাদ ফের অধিবেশন বসে। সরকারের নেতারা স্থির করেন বিলটি রাজ্যসভায় পাশ হওয়া বিলটি লোকসভায় অন্তত পেশ করা হোক। সেই মোতাবেক তিনটে বাজার কিছু আগে ট্রেজারি বেঞ্চের প্রথম সারিতে এসে বসেন সনিয়া। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কমলনাথ সভায় এসে কথা বলেন মুলায়ম সিংহ যাদবের সঙ্গে। তাঁকে অনুরোধ করেন বিলটি পেশ করতে দেওয়া হোক। মুলায়ম রাজি হননি। বরং জানিয়ে দেন, বিল পেশ রুখতে সমস্ত রকম ভাবে বাধা দেবে সপা। মুলায়মের এই মনোভাব সনিয়াকে জানান কমল নাথ।
এর পর নারায়ণস্বামী বিলটি পেশ করতে উঠে দাঁড়ান। প্রথমে পিছনের দিকে বসেছিলেন তিনি। কংগ্রেসের মন্ত্রী-সাংসদরা তাঁকে সনিয়ার পিছনের আসনে চলে আসতে বলেন। স্বামী তাই করেন। তিনি বিলটি পেশ করার সময় ঘাড় ঘুরিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন সনিয়া। এ সময় সপা-র যশবীর সিংহ লবি দিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসেন। তার পর নারায়ণস্বামীর পিঠের দিক থেকে হাত বাড়িয়ে বিলটি ছিনিয়ে নেন। আর এই দেখেই ক্ষিপ্রতার সঙ্গে উঠে দাঁড়ান কংগ্রেস সভানেত্রী। এক হাত দিয়ে যশবীরের বাঁ হাত ধরেন। অন্য হাত দিয়ে বিলটি ফেরত নেওয়ার চেষ্টায় টেনে ধরেন তাঁর সোয়েটার। বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে চলে এই টানা-হেঁচড়া। ক্ষুব্ধ কংগ্রেস সভানেত্রীকে বলতে শোনা যায়, “ডোন্ট ডু দিস।”
সনিয়া তাঁর হাত চেপে ধরবেন, এমনটা ভাবতে পারেননি যশবীরও। ঘাবড়ে গিয়ে তিনি বিলটি ছুড়ে ফেলে দেন। এই পরই স্পিকার মীরা কুমার সভা মুলতুবি করে দিলে তুমুল বচসা শুরু হয় কংগ্রেস-সপা সাংসদদের মধ্যে। ধাক্কাধাক্কি থেকে সনিয়াকে বাঁচাতে তাঁকে আড়াল করে দাঁড়ান প্রাক্তন মন্ত্রী সুবোধকান্ত সহায়। আবার এরই মধ্যে কংগ্রেসের বিলাস মুত্তেমওয়ার এসে ধাক্কা দেন যশবীরকে। সভা মুলতুবি হয়ে গেলে সাধারণত ঠান্ডা হয়ে আসে সভা। কিন্তু যশবীর ধাক্কা খেতেই ডামাডোল বেড়ে যায় আরও। মুত্তেমওয়ারের দিকে পাল্টা তেড়ে যান সপা সাংসদ তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখরের পুত্র নীরজশেখর। সনিয়া কেন জসবীরের হাত ধরে বাধা দিয়েছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন সপা নেতৃত্ব। বিতণ্ডার আগুণে ঘি ঢালতে উস্কানি দিতে থাকেন বিজেপি-র হুকুমদেও নারায়ণ যাদব।
প্রচুর হম্বিতম্বির পরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পরে কিন্তু লক্ষ্যণীয় ভাবে সুর পাল্টে ফেলে দুই শিবিরই। উভয় পক্ষই সংযত মত দেন। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী কমলনাথ গোড়ায় সপা সাংসদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের কথা তুললেও পরে কংগ্রেস মুখপাত্র রেণুকা চৌধুরি বলেন, “গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সবারই মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। কংগ্রেস হেডমাস্টার নয় যে কাউকে শাসন করবে। কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হলে স্পিকারই তা নেবেন।”
কিন্তু বিল ছিনিয়ে নেওয়া বা ছেঁড়ার মতো কাজকে কি আদৌ গণতান্ত্রিক ভাবে মত প্রকাশ বলা যাবে? এই প্রশ্ন করা হলে অবশ্য কোনও সদুত্তর দিতে পারেননি রেণুকা। পরে সুর বদলের ব্যাখ্যা মেলে কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়। তিনি বলেন, “সপা-র সঙ্গে ঝগড়া বাড়িয়ে লাভ কী? তা ছাড়া সপা-র সঙ্গে সনিয়ার বিবাদ নেই। তিনি ওই সাংসদের উপর চটে গিয়েছিলেন। ইদানীং এমনিতেই লোকসভায় আগের চেয়ে অনেকটাই কড়া মেজাজে থাকেন সনিয়া। বিরোধীদের আক্রমণের মুখে রুখে দাঁড়ান। দলের সাংসদরা সম্প্রতি তেলেঙ্গানার দাবিতে লোকসভায় হাঙ্গামা বাধালে তাঁদের সাসপেন্ড করারও নির্দেশ দিয়েছিলেন সনিয়াই।
গোটা পর্ব নিয়ে মুলায়ম পরে বলেন, “যা হয়েছে তা গোটা দেশ দেখেছে। সপা সাংসদদের ওপর হামলা হয়েছে। আবার লোকসভার সেই ভিডিও ফুটেজও মুছে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এর পরেও পদোন্নতিতে সংরক্ষণ বিলের বিরোধিতা করে যাবে সপা।” কিন্তু ইউপিএ-কে সমর্থনের প্রশ্নে দল নতুন করে ভাববে কি না জানতে চাওয়া হলে মুলায়ম বলেন, “এর মধ্যে সমর্থনের প্রসঙ্গ উঠছে কেন?”
পরে কংগ্রেস তথা সরকারি সূত্রে বলা হয়, বিলটি আজ লোকসভায় পাশ করানোর কথা ছিল না। সেই মর্মেই সমঝোতা হয়েছিল সপা-র সঙ্গে। এ ভাবে মায়া-মুলায়ম দু’জনকেই পাশ রেখে চলার কৌশল নিয়ে চলছে কংগ্রেস। তার মধ্যেই এটা একটা বিক্ষিপ্ত ঘটনা। |
|
|
|
|
|