দিল্লির গণধর্ষণের ঘটনায় সিসিটিভি-র ফুটেজ দেখে সহজেই চিহ্নিত করা গিয়েছিল বাসটি। সেই বাসের সূত্রে ধরা পড়ে অভিযুক্তেরাও। কিন্তু, বৃহত্তর কলকাতায় এমন অপরাধ ঘটলে শহরের পুলিশ কোথায় পাবে সিসিটিভি ফুটেজ?
হাতে গোনা কয়েকটি রাস্তা ছাড়া তো বৃহত্তর কলকাতায় কোনও সিসিটিভি ক্যামেরাই নেই। শহরের রাস্তায় পুলিশি টহল থাকলেও রাজপথে ছুটে যাওয়া প্রতিটি গাড়ি থামিয়ে তল্লাশি কার্যত অসম্ভব। রাস্তার উপরে রেলিং দিয়ে যেখানে গাড়ির গতি রোধের ব্যবস্থা থাকে, সেখানে তল্লাশি চললেও বেশির ভাগ রাস্তাই থেকে যায় অরক্ষিত। অপরাধের পরে রাতে কখন গাড়ি গ্যারাজে ফিরেছে, সেই সময় দেখে হয়তো বহু ক্ষেত্রে গাড়ি চিহ্নিত করা সম্ভব। কিন্তু, কলকাতায় তো তা-ও সম্ভব নয়। পারমিট নেওয়ার সময়ে নির্দিষ্ট গ্যারাজের ঠিকানা দেওয়া জরুরি। নিয়ম মতো সেই গ্যারাজেই রাতে থাকার কথা সেই বাসের।
কিন্তু, কলকাতার চিত্রটা ভিন্ন। রাতে শহরের রাস্তার পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বাস-মিনিবাস-স্কুলবাস। কোথায় গ্যারাজ? কোথায় লগ-বুক? রাজপথের কোনায় কখন চালক গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাখছেন, সে হিসেব কেউ রাখে না। বাস্তব হল, শহরের বুকে এত বড় গ্যারাজই নেই যেখানে অত সংখ্যক বাস রাতে থাকতে পারে। তবে বিকল্প কী? দিল্লির ঘটনার পরে আরও বড় হয়ে দেখা দেয় সেই প্রশ্ন।
টার্মিনাস থেকে বেরিয়ে যেমন অধিকাংশ সময়ে মিনিবাসের স্টিয়ারিং থাকে হেল্পারের হাতে, যাত্রীদের বসিয়ে যেমন তিনি খানিক হাত পাকান, তেমনই রাতে বেপরোয়া বাস-ট্যাক্সির স্টিয়ারিংও চলে যায় অন্যের হাতে। এক পুলিশ সার্জেন্টের কথায়, “ধরার চেষ্টা করি। কেসও দিই। এ পর্যন্ত যে সব গাড়ি বা বাসের ভিতরে অপরাধ ঘটেছে, তার একশো ভাগেরই কাচ কালো। গাড়ি দাঁড় করিয়ে কালো কাচের আড়ালে চলে মদ্যপান। কোনও ‘বড়লোক-পুত্রে’র গাড়িতে কালো কাচ দেখে কেস দিলে তিনি অবহেলায় একশো টাকা ‘জরিমানা’ দিয়ে চলে যান।”
সাত বছর আগে বেঙ্গালুরুতে একটি ট্যাক্সির ভিতরে স্থানীয় কল সেন্টারের এক মহিলা কর্মীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছিল। এর পরে ঠিক হয়, ট্যাক্সি, লাক্সারি ট্যাক্সিতে এমন ভাবে চালকের ছবি, নাম, ঠিকানা লিখে বা টাঙিয়ে রাখতে হবে, যা সহজেই যাত্রীদের নজরে আসবে। কিন্তু কলকাতায় সে নিয়ম কার্যত মানা হয় না। পরিবহণ দফতরের এক কর্তার অভিযোগ, মালিকের কাছে ড্রাইভিং লাইসেন্সের প্রতিলিপি জমা দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে যান এক চালক। বাস্তবে সেই গাড়ি চালান অন্য কেউ। গ্যারাজ রেজিস্টার লেখা হয় না বলে মালিকেরাও জানতে পারেন না, চালক কখন গাড়ি নিয়ে বেরোলেন, কোন সময়ে কোথা থেকে চালিয়ে গাড়ি গ্যারাজে ঢোকালেন।
কলকাতা পুলিশের এক কর্তার কথায়, “চালক অপরাধ করে ধরা পড়লেও প্রামাণ্য নথি হিসেবে এই রেজিস্টার আদালতে পেশ না করলে তিনি আইনের ফাঁক গলে ছাড়া পেয়ে যেতে পারেন।” গ্যারাজ রেজিস্টার যে নিয়মিত লেখা হয় না, তা স্বীকার করেন বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিমল গুহ। তিনি জানান, গাড়িতে চালকের বড় মাপের সচিত্র পরিচয়পত্র টাঙানো অত্যন্ত জরুরি। রাজ্য লাক্সারি ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক সৈকত পালও বিমলবাবুর বক্তব্য সমর্থন করে বলেন, “চালকের সচিত্র পরিচয়পত্র বড় করে টাঙানোর নির্দেশ দিক রাজ্য।” পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রের দাবি, কালো কাচ লাগানো গাড়ির বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা হবে। কিন্তু চলন্ত গাড়িতে অপরাধ হলে তা এড়ানোর উপায় কী? উত্তর মেলেনি কোথাও। পুলিশের এক কর্তা জানান, সেই অপরাধ এড়ানো কঠিন। তাঁর দাবি, বাসস্টপে, পানশালায় নজরদারি বাড়িয়ে, রাস্তায় তল্লাশি করে অনেক ক্ষেত্রে সাফল্য মিলছে। তবে দিল্লি বা বেঙ্গালুরুর মতো ঘটনা ঘটলে কী হবে তার জবাব তিনিও দিতে পারেননি। |