|
|
|
|
নেই তাই শান্তি, ছিল না কমিটির কালে |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা |
চার বছরও লাগল না ভাঙতে।
লালগড় দিয়ে শুরু হয়ে গোটা জঙ্গলমহল তো বটেই, এমনকী রাজ্য প্রশাসনকে পর্যন্ত এক সময়ে কাঁপিয়ে দিয়েছিল যাদের আন্দোলন, সেই পুলিশি সন্ত্রাস বিরোধী জনসাধারণের কমিটি এখন কার্যত অস্তিত্বহীন। আজ, ১৩ নভেম্বর মাওবাদীদের সমর্থনে গড়ে ওঠা কমিটির চার বছর পূর্ণ হচ্ছে। কিন্তু কোথায় কমিটি!
এক সময়ে যে জায়গা ছিল তাদের কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র, লালগড়ের সেই বড়পেলিয়া চকই আজ কমিটির বিলুপ্তির সাক্ষ্য দিচ্ছে। খা-খা করছে পিওন মাহাতোর চায়ের দোকান। ওখানেই খাটিয়া পেতে জনসাধারণের কমিটির সদর দফতর চালাতেন ছত্রধর মাহাতো। কাগজে-কলমে কমিটির মুখপাত্র, কিন্তু আমলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও মাওবাদী নেতা শশধর মাহাতোর দাদা ছত্রধর আসলে ছিলেন কমিটির একমাত্র জননেতা। সকাল থেকে সন্ধে থিকথিকে ভিড় লেগে থাকত তাঁকে ঘিরে। আর এখন?
ছত্রধরের এক সময়ের ছায়াসঙ্গী শ্যামল মাহাতো বললেন, “পুলিশের হাতে অত্যাচারিত আদিবাসী মহিলারা সম্প্রতি প্রত্যেকে এক লক্ষ টাকা করে পেয়েছেন। সেই ছোটপেলিয়া গ্রামে ঢোকার কোনও পাকা রাস্তা ছিল না। সেখানে পিচের রাস্তা হয়েছে। সেতুর কাজ হচ্ছে, কলেজ ও পলিটেকনিক কলেজ তৈরি হচ্ছে। পরিবর্তনের পর মানুষ কিন্তু এই এলাকায় খুশি।”
রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের (আইবি) অতিরিক্ত ডিরেক্টর জেনারেল বাণীব্রত বসু বলেন, “বেশ কিছু দিন ধরে, বিশেষ করে কিষেণজির মৃত্যুর পরে জঙ্গলমহলে জনসাধারণের কমিটির কার্যকলাপের খবর একেবারে নেই। কমিটি এক রকম শেষ হয়ে গিয়েছে। কমিটির শীর্ষনেতাদের কেউ কেউ মারা গিয়েছেন, কেউ কেউ জেলবন্দি। আবার নিশীথ মাহাতোর মতো কেউ কেউ শাসকদলে যোগ দিয়েছেন।”
তবে ছত্রধরের স্ত্রী নিয়তি মাহাতোর কথায়, “পিঠ বাঁচাতে, মামলা থেকে মুক্তি পেতে কমিটির অনেকেই তৃণমূলে যোগ দিয়েছে। সত্যিকারের শান্তি কিন্তু ফেরেনি। সিপিএমের মতো তৃণমূলও এলাকায় অত্যাচার চালাচ্ছে।”
রাস্তার ধারে বাস ধরার অপেক্ষায় বাঁশের মাচায় বসেছিলেন হাতে গোনা কয়েক জন। অত্যাচারের প্রসঙ্গ উঠতে তাঁদের মধ্যে এক প্রৌঢ়ের পর্যবেক্ষণ, “কমিটির আন্দোলনকে বরাবরই আদিবাসীদের গণ-আন্দোলন বলা হয়েছে। কিন্তু কিষেণজিরা বন্দুকের নলের ডগায় আদিবাসীদের আন্দোলনকে হাইজ্যাক করেছিল। মানুষের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ‘গণমিলিশিয়া’ গড়তে চেয়েছিল। যে কারণে কমিটি অল্প দিনের মধ্যেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল।” বাঁশপাহাড়ির সুখলতা পালের কথায়, “কমিটি নেই বলেই আমরা এখন শান্তিতে আছি।”
ছত্রধর মাহাতো ২০০৯-এর সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার হয়ে এখনও জেলবন্দি। তাঁর পরে কমিটির মুখপাত্র হন অসিত মাহাতো। তাঁকেও সম্প্রতি গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কমিটির কোষাধ্যক্ষ সুখশান্তি বাস্কেও
জেলে। কমিটির সভাপতি লালমোহন টুডু ও সিদো সরেন যৌথ বাহিনীর হাতে নিহত হন ২০১০-এ। মাওবাদীদের মদতে ও সমর্থনে গড়ে উঠেছিল এই কমিটি। কিন্তু মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে কোণঠাসা হওয়ার
আগেই কমিটির কার্যকলাপ কমতে শুরু করেছিল।
দলিলপুর চকের এক শিক্ষকের মতে, “অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চেয়েও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিলেন কমিটি-নেতারা। যথেচ্ছ লুঠ, তোলাবাজি, মারধর, গুম ও খুনের ঘটনায় নাজেহাল হয়ে পড়েন স্থানীয় মানুষ।” ওড়োলি গ্রামের সাবিত্রী ভূমিজ বলেন, “এক সময় ধান কাটার মরসুমে পেটে খিদে নিয়ে প্রায়দিনই মিছিলে ২৫-৩০ কিলোমিটার হেঁটেছি। চাপে পড়ে বাধ্য হয়েছি হাঁটতে। কমিটির লোকজনকে বহু দিনই এলাকায় দেখা যাচ্ছে না। এখন নিরুপদ্রবে ধান কাটছি।”
সিদোর মৃত্যুর পরে জনসাধারণের কমিটির সাধারণ সম্পাদক হন বিরকাঁড় গ্রামের মনোজ মাহাতো। দু’বার পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর মনোজ এখন জামিনে মুক্ত। মনোজই সে অর্থে কমিটির এখনও পর্যন্ত শেষ সাধারণ সম্পাদক। তাঁর কথায়, “আমার সাধারণ সম্পাদক থাকা, না থাকা একই। কমিটির এই মুহূর্তে কোনও কার্যকলাপ বা আন্দোলন নেই। এলাকায় এখন শান্তি রয়েছে। উন্নয়নমূলক কাজকর্ম চলছে
পুরোদমে। কমিটি যে-সব দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল, সেগুলির কয়েকটি পূরণ হয়েছে, কয়েকটি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। আন্দোলনের প্রয়োজন নেই, তাই কমিটিরও
অস্তিত্ব নেই।”
শালবনি এলাকায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কনভয় লক্ষ্য করে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ হয়েছিল ২০০৮-এর ২ নভেম্বর। তার জেরে শুরু হয় পুলিশি অভিযান। ৫ নভেম্বর রাতে লালগড়ের ছোটপেলিয়া গ্রামে আদিবাসী মহিলাদের উপর পুলিশি অত্যাচার চালায় বলে অভিযোগ ওঠে। এবং সেই অভিযোগকে ঘিরেই ১১ দফা দাবিকে সামনে রেখে ১৩ নভেম্বর জন্ম হয় কমিটির। তার পর দিন লালগড় থানায় প্রশাসনের কাছে ওই দাবি সনদ পেশের মধ্যে দিয়ে কমিটি
প্রকাশ্যে আসে।
তার পরের পর্ব তো ইতিহাস। |
|
|
|
|
|