সম্প্রতি সংবাদপত্রের ভিতরের পাতায় প্রকাশিত ছোট্ট একটি সংবাদ নজরে পড়ল। উত্তরবঙ্গের চা-বাগানের মালিকরা মহাত্মা গাঁধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্প (সংক্ষেপে এমজিএনআরইজিএ, চলতি কথায় ‘একশো দিনের কাজ’) নিয়ে উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রীর কাছে অনুযোগ করেছেন। এই প্রকল্পের ফলে তাঁদের শ্রমিক নিয়োগে অসুবিধে হচ্ছে, চলতি মজুরিতে কেউ কাজ করতে আগ্রহী নয়। এমন চললে নাকি তাঁদের বাগান বন্ধ করে দিতে হবে। মন্ত্রী বলেছেন ‘দেখছি’। বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োগকারীদের থেকে এমন অনুযোগ শোনা যাচ্ছে বেশ কিছু কাল ধরেই। কেরলের চিংড়ি-খোসা ছাড়ানোর কারবারি থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের জোতমালিক অনেকেই তাঁদের অসুবিধের কথা জানাচ্ছেন।
সে দিন গেছি পাড়ার রবিদার দোকানে। খুব উত্তেজিত কণ্ঠে রবিদাকে ফোনে কথা বলতে শুনি। ফোন শেষ হতে জিজ্ঞেস করি, ‘কী হল রবিদা’? ‘আর বোলো না। সে দিন বলল একটা ছেলে পাঠাবে দোকানের জন্যে। এখন বলছে সে আসবে না। আসবে কেন? ওই একশো দিনের কাজে এক ঝুড়ি মাটি কেটেই যদি একশো টাকা পেয়ে যায়, দোকানে কাজ করতে আসবে কেন?’ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ গ্রুপের একটি সাম্প্রতিক গবেষণা রিপোর্টেও বলা হয়েছে একশো দিনের কাজের ফলে অন্ধ্রপ্রদেশে ধান উৎপাদনের খরচ অনেক বেড়ে গিয়েছে। রাজ্যের গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী ডোক্কা মাণিক্য বরপ্রসাদ অবশ্য সরাসরিই বলে দিয়েছেন, এমনটাই তো হবে। একশো দিনের কাজের ফলে গ্রামীণ মজুরি বেড়েছে, শ্রমিকদের এখন দর কষাকষির ক্ষমতা অনেকটা বেড়েছে। ফলে নিয়োগকারীদের অভিযোগ তো স্বাভাবিক ভাবেই থাকবে। তা বলে প্রকল্পটিকে কাঠগড়ায় তুলতে হবে নাকি?
শুরু থেকেই এমজিএনআরইজিএ প্রকল্প নানান সমালোচনার মুখে পড়ে। সাধারণ ভাবে যে দু’টি সমালোচনা বারবার শোনা যাচ্ছিল দুর্নীতি ও অপচয় নিয়ে। ব্যাপক দুর্নীতির ফলে এক দিকে যেমন টাকা চলে যাচ্ছে স্থানীয় ক্ষমতাবানদের পকেটে, অন্য দিকে যাঁদের প্রকৃত প্রয়োজন রয়েছে, টাকাটা তাঁদের পকেটে গেলেও যে সব গ্রামীণ সম্পদ বা পরিকাঠামো তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা হচ্ছে না। এই জোড়া সমালোচনার সঙ্গে ইদানীং যুক্ত হয়েছে কৃষি উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়া এবং তজ্জনিত সংকটের গল্পটি। এই তিন সমালোচনারই কিছুটা সত্যতা থাকলেও গ্রামীণ অর্থনীতিতে প্রকল্পটির ব্যাপক প্রভাবের প্রেক্ষিতে এমন সমালোচনাকে ঠিক কতটা গুরুত্ব দেওয়া উচিত সে বিষয়ে আরও তথ্যভিত্তিক আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। |
একশো দিনের কাজের প্রভাব গ্রামীণ অর্থনীতিতে, বিশেষত গ্রামের বাজারে কতটা পড়েছে তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায় কৃষিতে মজুরির হারে পরিবর্তনের দিকে দেখলে। ভারত সরকারের লেবার ব্যুরো বিভিন্ন রাজ্যে মজুরির হার নিয়মিত সংগ্রহ করে থাকে। ২০০৪ সাল থেকে ২০১২-র এপ্রিল পর্যন্ত প্রতি মাসের মজুরির বিশদ পরিসংখ্যান সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া এক সঙ্গে জড়ো করে উপস্থাপন করেছে। কৃষিতে বিভিন্ন কাজের জন্যে আলাদা মজুরির হারের সিরিজ সেখানে পাওয়া যাচ্ছে। জটিলতা এড়াতে শুধু ফসল-কাটার মজুরিকেই কৃষিমজুরির হার হিসেবে ধরে নেওয়া যাক। দেখা যাচ্ছে, সামগ্রিক ভাবে ভারতে এই মজুরির হার ২০০৪ থেকে ২০০৬-০৭ পর্যন্ত যে ভাবে বেড়েছে তা কৃষিমজুরদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মূল্যসূচকের বৃদ্ধির থেকে বেশি নয়। অর্থাৎ এই সময়কালে কৃষিতে প্রকৃত মজুরি প্রায় বাড়েনি বললেই চলে। অথচ তার পর থেকেই দেখছি মজুরির হারে বৃদ্ধি মূল্যসূচকের ঊর্ধ্বগতিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে ক্রমশই। অর্থাৎ বলা যায় সামগ্রিক ভাবে গোটা দেশে কৃষিতে প্রকৃত মজুরির হার গত পাঁচ বছরে বেশ খানিকটা বেড়েছে। তবে এই বৃদ্ধির কতটা এমজিএনআরইজি-এর কারণে আর কতটা অন্য কারণে, তা নিশ্চিত ভাবে বলতে গেলে অবশ্যই আরও গবেষণার প্রয়োজন।
সামগ্রিক ভারতের গড়পড়তা চিত্রটি থেকে নেমে এসে যদি রাজ্যগুলিকে দেখি, তা হলে দুইয়ের মধ্যে সম্পর্কটি আর একটু স্পষ্ট হয়। যে রাজ্যগুলিতে মজুরির হারে সর্বাধিক বৃদ্ধি ঘটেছে, যেমন অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক কিংবা তামিলনাড়ু, সেখানেই আবার দেখা যাচ্ছে এমজিএনআরইজি-এর সাফল্যও আপেক্ষিক ভাবে বেশি। ২০১১-১২ সালে এই তিন রাজ্যেই যে সমস্ত পরিবার আবেদন করেছে, তাঁদের পরিবার পিছু প্রায় পঞ্চাশ দিন কাজ দেওয়া গেছে। পশ্চিমবঙ্গে যা মাত্র সাতাশ। পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও অসম কিংবা গুজরাট রয়েছে, যেখানে প্রকল্পটি কম সফল। এবং দেখা যাচ্ছে প্রথমোক্ত তিনটি দক্ষিণী রাজ্যের তুলনায় শেষোক্ত তিনটি রাজ্যে মজুরি অনেক কম বেড়েছে। অর্থাৎ রাজ্যগুলিকে আলাদা করে দেখলে একশো দিনের কাজে সাফল্য আর কৃষিতে মজুরি বৃদ্ধির মধ্যে ও একটা কার্য-কারণ সম্পর্ক যেন পাওয়া যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে কৃষিমজুরি যে আপেক্ষিক ভাবে কম বেড়েছে তাই নয়, কৃষিমজুরির হারও অনেক রাজ্যের তুলনায় কম। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্যে দেখছি তামিলনাড়ু, কেরল, পঞ্জাব, হরিয়ানা, হিমাচলপ্রদেশে মজুরির হার পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকী রাজস্থানেও। এখান থেকেই কয়েকটি বিষয় উঠে আসছে যা বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে। পশ্চিমবঙ্গে যে হেতু কৃষিমজুরি তুলনামূলক ভাবে কম, এমজিএনআরইজি-এ প্রকল্পে বেঁধে দেওয়া ন্যূনতম মজুরি পাওয়া যায়, যা বাজারে চালু মজুরির থেকে বেশি। তা হলে এ রাজ্যে কম দিন কর্মসংস্থান হওয়ার অর্থ যত জন কাজ চাইছেন, তত জন পাচ্ছেন না। তবে এই অতিরিক্ত চাহিদার হদিশ সরকারি নথিতে পাওয়া যাবে না। কোনও রাজ্যেই তা পাওয়া যায় না। যেহেতু কেউ পঞ্চায়েতের কাছে কাজ চাইলে তাঁকে পনেরো দিনের মধ্যে কাজ দিতে হবে, না হলে বেকার ভাতা দিতে হবে, তাই সব সময়েই হিসেবে দেখানো হয় কাজের চাহিদা আর কর্মসংস্থানের পরিমাণ সমান সমান। আর যেহেতু বেকারভাতাটা রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকেই দিতে হয়, তাই চাহিদাকেই ছেঁটে ফেলা হয় প্রকল্পে টাকা নেই বলে। অথচ প্রকল্পটি খাতায়-কলমে ‘চাহিদা-চালিত’, অর্থাৎ চাহিদা থাকলে কর্মসংস্থান করতেই হবে। অর্থ বরাদ্দের কোনও সীমা বেঁধে দেওয়া নেই। তা হলে কি টাকার অভাবের কথাটি মিথ্যা? পঞ্চায়েত স্তরে তাৎক্ষণিক ভাবে সত্যি। কিন্তু এই অর্থাভাবটা হতে পারে কারণ প্রকল্পের জন্য যখন পরিকল্পনা করা হয় নীচের দিক থেকে ধাপে ধাপে, তখন চাহিদার যথাসম্ভব আন্দাজ নিয়ে তা করা হয়নি। শুধু তাই নয়, পরিকল্পনা দেখিয়ে কেন্দ্র থেকে যতটা বরাদ্দ পাওয়া গেল তা-ও দেখা গেল খরচ হয়ে উঠল না স্থানীয় স্তরে সমস্যার জন্যে। ২০১১-১২ সালে তাই হল। আর্থিক বছরের প্রথম ছ’মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে হয়ত। তা হোক। যাঁদের কাজ পাওয়ার কথা তাঁরা পেলেই হল।
গ্রামাঞ্চলে জীবনযাত্রার মান বাড়াতে হলে মজুরির হার বাড়াতে হবে। আর মজুরির হার বাড়ার অনেকটাই যে নির্ভর করছে এমজিএনআরইজি-এর সাফল্যের ওপর, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। পশ্চিমবঙ্গে প্রতি হেক্টর জমিতে কৃষি উৎপাদনের পরিমাণ সর্বভারতীয় স্তরের থেকে কম নয়। তা হলে মজুরি কম কেন? ফসলের দাম কম কেন?
হতে পারে ফসলের সরকার নির্ধারিত সাহায্য-মূল্যের সুফল কৃষকরা সমান ভাবে পান না সব রাজ্যে, তাই। অন্য দিকে, হতে পারে হেক্টর প্রতি এ রাজ্যে বেশি সংখ্যক মজুর নিয়োজিত হচ্ছে, ফলে শ্রমের উৎপাদনশীলতা কম, মজুরিও কম। আর এই চক্রটি চলতে থাকছে, কারণ অধিকাংশ খেতমজুরদেরই বিকল্প সংস্থানের অভাব। এর ফলে আবার খেতমজুর ও মালিকের দর কষাকষিতে মালিকের দিকেই পাল্লাটা ভারী হয়। অদক্ষ শ্রমিকের অতিরিক্ত জোগান দর কষাকষিতে শ্রমিককে দুর্বল করে। অবশ্য এ ক্ষেত্রে অন্য রাজনৈতিক অর্থনীতিও কাজ করে। বাম আমলের শেষার্ধে গ্রামীণ রাজনীতিতে খেতমজুরদের থেকে তাদের নিয়োগকর্তাদের ক্ষমতা যে অনেকটাই বেশি ছিল, তা অনেক পর্যবেক্ষকই বলেছেন। এই রাজনৈতিক অর্থনীতি মাথায় রাখলে বুঝতে অসুবিধে হয় না একশো দিনের কাজ প্রকল্প সফল হোক, এমনটা হয়তো অনেকেই চাইবেন না, সস্তা শ্রমের সুবিধায় যাঁরা অভ্যস্ত কৃষিজোতের মালিক থেকে শহরের অধ্যাপক। ভোটবাজারে শ্রেণি হিসেবে কাদের গুরুত্ব বেশি হবে তার উপরই নির্ভর করছে এমজিএনআরইজি-এর ভবিষ্যৎ। এ বছরে কেন্দ্রীয় বাজেটে এই প্রকল্পে বরাদ্দ কমে যাওয়ায় তার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।
ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ, কলকাতা’য় অর্থনীতির শিক্ষক |