নির্বাচনে জিতলে অথবা হারলেও কী ভাবে বক্তব্য রাখতে হয়, আমেরিকানরা খুব ভাল ভাবে জানে। প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দ্বিতীয় বার জয়ী হয়ে বারাক ওবামা প্রথম প্রতিক্রিয়া যা বললেন, তা খুব ভাল লাগল। মনে হল, আমাদের জাতীয় নেতারা এ ভাবে চিন্তা করতে বা কথা বলতে কি পারেন না? ওবামা বললেন রোমনির বাবা-মা-র কথা। তাঁরা রাজনীতিতে ছিলেন, তাঁদের ছেলেও দেশের সেবা করতে চান। রোমনি নূতন জমানার প্রতি তাঁর অকুণ্ঠ সমর্থন তো জানালেনই, সঙ্গে জানালেন ওবামার স্ত্রী ও দুই কন্যার জন্য আন্তরিক শুভেচ্ছা।
দেশে খবরকাগজ বা টিভি খুললেই দেখতে হয় কোনও নেতা অপরকে বলছেন, তুমি চোর। অন্য জন রেগে বলছেন, তুমিও তো তা-ই। জবাবে: ‘হতে পারে, কিন্তু তুমি আরও বড় ডাকাত।’ এ যেন হ্যাঁরে, হ্যাঁরে তুই নাকি কাল সাদাকে বলেছিলি লাল, আর তোদের পোষা বেড়ালগুলো শুনছি নাকি বেজায় হুলো? আর জবাবে: ‘চোপ রও তুম, স্পিকটি নট, মারব রাগে পটাপট,’ ইত্যাদি। এই রকম পাবলিক কাজিয়া বিশ্বের দরবারে আমাদের মাথা হেঁট করে দেয়।
বছর আট আগে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে আমেরিকাতেই ছিলাম। বন্ধুরা লাইন দিয়ে ভোট দিচ্ছেন বাড়ির ভিতরে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে শীতে কাঁপছি। আমার মতো আরও অনেকের মনোবাসনার বিরুদ্ধে সে বার বুশ জিতলেন। চার বছর আগে ওবামার জয়ের সময়ে রয়েছি কলকাতার পার্ক স্ট্রিটে। সে সময়ে কলকাতায় বেশ জনপ্রিয় আমেরিকান মহিলা কন্সাল-জেনারেল বেথ পেন ব্যবস্থা করেছেন, মস্ত স্ক্রিনে নির্বাচন দেখছি। টান-টান উত্তেজনা। ওবামার জয় নিশ্চিত হওয়া মাত্রই প্রবল উচ্ছ্বাস।
এ বার রয়েছি লন্ডন শহরে। আমেরিকার বন্ধুদের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ হচ্ছে স্কাইপ-এ, ই-মেলে। আমেরিকান অধ্যাপক জানালেন, ‘ওবামা এই চার বছরে আহামরি কিছু করতে পারেনি, তবুও ওবামাকেই ভোট দেব।’ নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির প্রথম বর্ষের ছাত্রজীবনে প্রথম ভোট দেবে। দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে জানাল, ‘ওবামাকে ভোট দিচ্ছি।’ জয়ের পর দেখা যাচ্ছে তরুণ ভোটাররা ষাট পার্সেন্ট ওবামাকেই ভোট দিয়েছে। |
নির্বাচনের ঠিক আগে ভোট-বিশেষজ্ঞরা যখন জানালেন, ওবামা ৪৯ পার্সেন্ট আর রোমনি ৪৯ পার্সেন্ট, ওবামা সমর্থকেরা চিন্তায় পড়েছিলেন। ফলাফল দেখাচ্ছে, তাঁরা ঠিকই বলেছিলেন। দেশের মানুষ সরাসরি ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান দু’ভাগে সমান ভাগ হয়ে গিয়েছে। মহিলা, তরুণ সমাজ, কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা ওবামার দিকে। সাধারণ ভাবে নিম্নবিত্ত মানুষেরা ওবামাপন্থী। তার কারণ, রোমনির পরিচয় জনসাধারণের কাছে এই যে, তিনি বেজায় বড়লোক। আমাদের কাছে, ধরতে পারেন যে, বড়লোক শিল্পপতি মুম্বইতে সাতাশতলা বাড়ি বানিয়ে সেখানে বসবাস করেন, তার প্রতিচ্ছবি যেমন। অত উঁচুতে থাকলে নীচের ঝুপড়িতে যারা থাকে, তাদের দুঃখকষ্ট উনি কী বুঝবেন! রোমনির এই ইমেজ মুছে ফেলার একটা চেষ্টা হয়েছিল, সফল হয়নি। কোনও রাজনীতিক সম্পর্কে জনতার মনে বিশেষ বদ্ধমূল ধারণা ‘পারসেপশন’ হয়ে যাওয়া খুব বিপজ্জনক।
এ বারের নির্বাচনে স্যান্ডি নামে সাইক্লোনও কিছু প্রভাব ফেলে থাকবে। সাধারণ ভাবে আমেরিকার বিভিন্ন স্টেট বা রাজ্যে কোন দল সংখ্যাগরিষ্ঠ, তা জানাই থাকে। যে সব রাজ্য দোলাচলে বা সুইং স্টেট, তার উপর নির্ভর করে প্রার্থীর ভাগ্য। এ বিষয়ে ফ্লোরিডা-রাজ্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ওহায়োর মতো আর এক দোলাচল রাজ্যে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী যখন নির্বাচনী প্রচারে যাবেন, স্যান্ডি আছড়ে পড়ল পূর্ব উপকূলে। আমাদের অনেকেরই বন্ধুবান্ধব, স্বজন নিউ ইয়র্ক বা নিউ জার্সিতে বিদ্যুৎবিহীন দিন কাটিয়েছেন। জলমগ্ন সাধারণ মানুষের কষ্ট কেমন হয় আমরা জানি। ওবামা প্রশাসন ত্রাণ কাজে প্রশংসা পেলেন, এমনকি বিরোধীদের কাছেও। সকল পক্ষই নির্বাচনী প্রচার থামিয়ে ত্রাণ কাজে নেমেছে। তবুও প্রশাসনে যাঁরা আছেন, তাঁদের দায়িত্ব বেশি।
ভোটের দিন কেমন ভোট চলছে খোঁজ নিচ্ছিলাম। বস্টন এলাকার অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা জানালেন, সকালে গিয়ে দেখেন দীর্ঘ লাইন। এ দিকে ক্লাস নিতে হবে, দেরি হয়ে যাচ্ছে। অতএব ক্লাস নিতে চলে গেলেন। জেনে আশ্বস্ত হলাম, কলেজ থেকে ফিরবার পথে তিনি ওবামাকে ভোট দিতে যাবেন।
এই একটা ব্যাপার আমাদের আশ্চর্য করে। অফিস থেকে লাঞ্চ টাইমে বেরিয়ে অথবা দুটো ক্লাসের ফাঁকে টুক্ করে গিয়ে ভোট দিয়ে আসব। আমাদের তো নির্বাচন মানে মহোৎসব, ছুটির দিন। সে দিন ক্লাস করতে যাব কোন দুঃখে! দলীয় কর্মীদের কত কাজ থাকে। ভোটারদের বাড়ি থেকে বার করে আনা, রিগিং ঠেকানো অথবা করা। আমার কর্মীরা স্লোগান দিতেন ‘সকাল সকাল ভোট দিন, নিজের ভোট নিজে দিন।’ বিদেশি বন্ধুরা অবাক। অন্য রকম ভোট দেওয়া যায় নাকি?
যে কথা বলতে চেয়েছিলাম জয়ে অথবা পরাজয়ে আমেরিকার রাজনীতিকের দৃষ্টিভঙ্গি। রোমনি নাকি জয়ী হলে কী বলবেন, তা এরোপ্লেনে বসে লিখে ফেলেছিলেন। কী লিখেছিলেন জানি না। পরাজিত হয়ে যা বলেছেন ভালই। ওবামা জয়ের মুহূর্তে কী বললেন? লন্ডনের ভোররাত্রে কফির মগ-হাতে টিভির সামনে সপরিবার বসেছি। ওবামা জিতলেন। ওবামার হাসিমুখ, উল্লসিত জনতার দৃশ্য। নীচে তাঁর বক্তব্য বলে যে লেখাটি ফুটে উঠল, তা এই ‘আমরা সকলে একই পরিবারের, আমেরিকান নেশন হিসেবে আমাদের উত্থান বা পতন একই সূত্রে গাঁথা।’ এই রাষ্ট্রীয় একতার ছবিটি আমাদের দেশে দেখতে পাই না। নিজের অত্যন্ত ক্ষুদ্র সংসদীয় অভিজ্ঞতায় দেখেছি, জয়ের পর যখন বলবার চেষ্টা করেছি এই সামান্য সংসদ এলাকাতে আজ থেকে আমি আপনাদের সকলের বিরোধী পক্ষ অত্যন্ত সন্দিগ্ধ, নিজের পক্ষ বিক্ষুব্ধ। বিরোধীরা ভাবছেন, কী মতলব! আমার নিজের পক্ষ বলছে, দিদি সংসদ তহবিল থেকে ওদের কেন টাকা দিলেন, দেবেন না।
এই আমরা-ওরা বিভাজন কাটিয়ে ওঠা কঠিন। কেন্দ্র বা রাজ্য সব স্তরেই। বেশি দিন হয়নি। মাত্র পঁয়ষট্টি বছর আগে অগণিত সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। জগৎসভায় সসম্মানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে কখনও কখনও সংকীর্ণ দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাষ্ট্রীয় চেতনার পরিচয় দেওয়া একান্ত জরুরি। |