দেড় দশক হইয়া গেল, শব্দবাজির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হইয়াছে। গোড়ায় পুলিশ তৎপর ছিল, শব্দবাজির দাপটও কমিয়াছিল। তাহার পর যেমন হয়, পুলিশ অন্য দিকে কান ফিরাইয়াছে, শব্দবাজিও তাহার মহিমা ফিরিয়া পাইয়াছে। এই দীপাবলি ব্যতিক্রমী হইতে পারে বলিয়া ইঙ্গিত মিলিতেছে। পুলিশ সক্রিয়, শব্দবাজির বিরুদ্ধে বিবিধ অভিযান চলিতেছে। প্রচারও হইতেছে। বাজির বাজারের খবর, শব্দবাজির চাহিদা হ্রাস পাইয়াছে। মানুষ আলোয় মাতিতেছেন। পুলিশের নজরদারির সহিত শব্দবাজির প্রাবল্যের সম্পর্কটি কেন ব্যস্তানুপাতিক, তাহার ব্যাখ্যা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ গ্যারি বেকার-এর ‘সিম্পল মডেল অব র্যাশনাল ক্রাইম’-এ পাওয়া যাইবে। শব্দবাজি ফাটানো যে আইনত অন্যায়, কথাটি এতদিনে নাগরিকমাত্রেই জানেন। কিন্তু বিকট শব্দে পাড়া কাঁপাইয়া দিবার মধ্যে যে আনন্দ আছে, তাহাও কম নহে। যাঁহারা সেই আনন্দ উপভোগ করেন, তাঁহারা হয় সচেতন ভাবে, নয় অবচেতনেই হিসাব কষিয়া দেখেন, এই অন্যায় করিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়িয়া শাস্তি পাইবার সম্ভাবনা কতখানি? যদি প্রত্যাশিত শাস্তির পরিমাণ বাজি ফাটাইবার আনন্দের তুলনায় কম হয়, বাজি ফাটানোই তাঁহাদের নিকট যুক্তিসঙ্গত। পুলিশের নজরদারি কম থাকিলে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা কম। ধরা পড়িলেও শাস্তি আর কতটুকুই বা হয়? ফলে, শব্দবাজি অদম্য। পুলিশ এই বৎসর নজরদারি বাড়াইয়াছে। শব্দবাজি ফাটাইলে অপরাধীদের গ্রেফতার করা হউক। তাহাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও হউক। মানুষের মনে শাস্তির ভয় জন্মিলে আইন ভাঙিবার প্রবণতা কমিতে বাধ্য। বাজি ফাটাইয়া দুই বৎসর জেলের ঘানি টানিতে হইলে বেয়াড়া মোচ্ছবের প্রবণতা কমিবে। শাস্তি যে হইয়াছে, এই কথাটিও যথাসম্ভব প্রচার করিতে হইবে। লোকলজ্জার ভয়ও নেহাত কম নহে। অনুমান করা চলে, রাজ্যের একটি বড় অংশের মানুষের শব্দবাজিতে আগ্রহ নাই। কিন্তু নিজে শব্দবাজি না ফাটাইলেই নাগরিক দায়িত্ব সম্পন্ন হয় না। প্রতিবেশী যদি কানে তালা ধরানো বোমা ফাটাইয়া উৎসব পালনে মাতে, তবে আদর্শ প্রতিবেশীর কর্তব্য, পুলিশকে সেই খবরটি জানাইয়া দেওয়া। পুলিশের উপর চাপ সৃষ্টি করা, যাহাতে অপরাধীরা ছাড়া না পায়। ‘অপরাধী’ শব্দটি অনেকের কানে কড়া ঠেকিতে পারে যে দেশে কোটি কোটি টাকা তছরুপ হইতেছে, যখন তখন খুন-ডাকাতি-ধর্ষণ হইতেছে, সেই দেশে কয়েকটি শব্দবাজি ফাটানোকে ‘অপরাধ’ বলা কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি নহে? বিন্দুমাত্র নহে। অপরাধের লঘুগুরু ভেদ অবশ্যই আছে কেহই চকলেট বোমা ফাটানো আর ধর্ষণকে সমগোত্রের অপরাধ বলিবেন না। কিন্তু উভয়ই অপরাধ। আইন লঙ্ঘিত হইলেই অপরাধ। শাস্তিরও লঘুগুরু ভেদ থাকিবে। কিন্তু শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। সেই শাস্তি যাহাতে হয়, তাহা নিশ্চিত করিতে নাগরিকদের পুলিশের সহিত সহযোগিতা করিতে হইবে। ইহা সামাজিক দায়িত্ব। বস্তুত, অপরাধের বিরুদ্ধে সরব হওয়ার অভ্যাসটি গড়িয়া তোলা প্রয়োজন। শুভ দীপাবলিতেই সেই অভ্যাসের সূচনা হউক। |