দুঃখের লেশমাত্র নেই, হকিংকে দৃষ্টান্ত মেনে এগিয়ে যাচ্ছে রূপম
পা দু’টি অসাড়। নাড়তে পারে না ডান হাতও। এমন ছেলেকে রাখতে চায়নি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়। ভর্তির পরের দিনই বলা হল, ফি ফিরিয়ে নিন, ছেলেকে নিয়ে যান।
সেরিব্রাল পলসি ছোঁয়াচে নয়, স্নায়ুর রোগ কিছুতেই বোঝানো যায়নি কর্তৃপক্ষকে।
বাবা বিদ্যুৎ বিভাগে চাকুরে। কাকা-জেঠুরা কেউ স্কুলশিক্ষক, কেউ পড়ান কলেজে। এমন ঘরের ছেলে, রূপম মুখ্যু থাকবে! পাশের স্কুলের কর্তৃপক্ষ বললেন, ভর্তি করা যেতে পারে। কিন্তু রূপম স্কুলে আসবে সপ্তাহে একদিন। পুরো সপ্তাহের হোমওয়র্ক সেই দিনই নিয়ে যাবে। ঘরে বসে পড়া তৈরি করবে। অগত্যা তাতেই রাজি হলেন মা-বাবা।
ডিব্রুগড়ের রূপম ভট্টাচার্যের লড়াই সেই থেকে শুরু। পড়া আর পড়া। সাত দিনের কোর্স এক দিনে শেষ। স্কুল কর্তৃপক্ষ যে চ্যালেঞ্জটা ছুড়ে দিয়েছিলেন, সেটাই রূপম তার মন্ত্র করে নিয়েছিল। আর সেই মন্ত্রই তাকে ফিরিয়ে দিল স্কুলে। রূপমের দ্রুত শেখার ক্ষমতা আর ভাল রেজাল্ট দেখে এ বার শিক্ষকরাই তাকে কাছে টেনে নিলেন। নিয়মিত স্কুলে যাওয়ার অনুমতি মিলল। মাধ্যমিকে ৮২ শতাংশ, উচ্চ মাধ্যমিকে ৭৮ শতাংশ এবং পরে জয়েন্ট এন্ট্রান্স উত্তীর্ণ হয়ে রূপম এখন শিলচর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির বি-টেক তৃতীয় সেমিস্টারের ছাত্র। পড়ছে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।
মায়ের সঙ্গে রূপম। ছবি: দিলীপ রায়।
সবাই ভেবেছিলেন, মোটেও দাঁড়াতে পারে না যে ছেলে, সে বি-টেক করবে কী করে! রূপম সবার আশঙ্কা ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। রূপমের মা মিতা ভট্টাচার্যের একটাই আবেদন ছিল, ‘‘ক্যাম্পাসে ওর সঙ্গে আমাকেও থাকার ব্যবস্থা করে দিন।’’ ইতিউতি করে শেষ পর্যন্ত স্টাফ কোয়ার্টারের একটি ঘর বরাদ্দ হল মা-ছেলের জন্য। কলেজের এক ভ্যানচালককেও বলে দেওয়া হল, সকালে রূপমকে ক্লাসে নিয়ে আসবে আর বিকেলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। মা আর ছেলে এখন শিলচর এনআইটি-র গর্ব।
সকাল আটটায় কলেজের গাড়িতে চেপে ক্লাসে আসে রূপম। যতক্ষণ না বিকেলে ক্লাস শেষের ঘন্টি বাজে, বাইরে বসে থাকেন মিতাদেবী। ক্লাস শেষ হলে ছেলেকে ধরাধরি করে গাড়িতে বসিয়ে রওনা হন কোয়ার্টারে। ক’দিন আগে বিষয়টি নজরে পড়ে ডিরেক্টর এন ভি দেশপান্ডের। খোঁজ নিয়ে দেখেন, রূপমদের বাড়ি ডিব্রুগড়ে। বাবা সুভাষ ভট্টাচার্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বাড়িতে। একমাত্র বোন, ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। বাবার সঙ্গে বাড়িতেই থাকে। চার জনের সংসারে আসলে এখন আর কোনও আয় নেই।
দেশপান্ডে ঘোষণা করলেন, শিলচর এনআইটি-তে কোনও দিন টিউশন ফি লাগবে না রূপমের। এ পর্যন্ত যে ফি জমা হয়েছে, ফিরিয়ে দেওয়া হবে তা-ও। সঙ্গে প্রতিষ্ঠানের তহবিল থেকে কিনে দেওয়া হল ‘জয়স্টিক-কনট্রোল পাওয়ার-হুইলচেয়ার’। রূপমের কথায়, “ঘরে চলাফেরায় বড় সুবিধে হল। চেয়ারে বসিয়ে দিলে নিজেই এ-ঘর ও-ঘর করতে পারি।” ঠেলা-ধাক্কার প্রয়োজন নেই। চেয়ারের হাতলেই সুইচ। সামনে কি পেছনেযেমন কমান্ড মিলবে, তেমনই যাবে। আর ক্লাসে? রূপমের কথায়, ‘‘মা আর ভ্যানচালক ধরাধরি করে বসিয়ে দিলে আর সমস্যা নেই। খুব প্রয়োজন ছাড়া নড়াচড়া করি না। আর প্রয়োজনের সময় বন্ধুর অভাব পড়ে না।’’
রূপমদের কোয়ার্টারে বসে ছিলেন ফণিভূষণ নাথ, মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ইনস্ট্রাকটর। বললেন, সপ্তাহে এক দিন এসে রূপমকে না দেখলে অস্বস্তি হয়। শুধু তিনিই নন, তাঁর মতো অনেকেই আসেন, দু’চার দিন পর-পর খবর নিয়ে যান। রূপম হাসে, ‘‘আর বন্ধুদের ফোন তো লেগেই থাকে।’’ জীবনে কোনও দুঃখজনক ঘটনা কষ্ট করেও মনে করতে পারে না! স্কুল থেকে এনআইটি, ছাত্র কিংবা শিক্ষক সবার কাছ থেকে পাওয়া সাহায্যের কথাই শোনায় ২০ বছরের রূপম! সবই সুখের কথা।
খেলাধুলো বড় পছন্দের। উচ্চ মাধ্যমিকের অঙ্ক পরীক্ষার আগের দিনও ভারত বনাম ইংল্যান্ড ক্রিকেট ম্যাচ বাদ দেয়নি রূপম। অন্যদের ব্যাট-বল হাতে দৌড়তে দেখে কষ্ট হয় না? পাশে বসা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ধীর লয়ে জবাব দেয় রূপম, ‘‘না। চোখের সামনে ভাসে স্টিফেন হকিংয়ের ছবি। পরিণত বয়সে তাঁর এ-রোগ ধরা পড়লেও ভাবি, তাঁর সমস্যাটা যে আমার চেয়েও কঠিন!’’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.