|
|
|
|
 |
ধানের ফলনে ঘাটতির
দৌড়ে অশনি সঙ্কেত
সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা |
|
কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপ— সবুজে সবুজ। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ ভরে রয়েছে কচি ধানের গাছে।
কিন্তু এই সবুজ খেত শেষমেশ চাষির গোলা সোনালি ধানে ভরিয়ে দেবে তো?
পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে ‘খরার’ কোনও ঘোষণা না-থাকলেও সংশয়টা এখন যথেষ্ট প্রকট। ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারি হিসেব মোতাবেক, এই খরিফ মরসুমে রাজ্যে লক্ষ্যমাত্রার অন্তত ৯৩% জমিতে ধান রোয়া হয়ে গিয়েছে। তবু রোপণের সময় ও বৃষ্টিপাতের ধরন বিশ্লেষণ করে কৃষি দফতরের আশঙ্কা, খরিফে উৎপাদন হবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অন্তত ১৩ লক্ষ টন কম! কেন?
কৃষি-সূত্রের তথ্য: বৃষ্টির অভাবে প্রায় পৌনে দু’লক্ষ হেক্টর জমিতে চাষিরা ধান রোয়া শুরুই করতে পারেননি। এবং কম- বেশি ওই সওয়া পাঁচ লক্ষ চাষির পক্ষে এ বার খরিফে ধান ফলানো কার্যত অসম্ভব। আবার খরিফে এ রাজ্যে ধান রোয়ার ‘সরকারি সময়’ ১৫ জুলাই থেকে ১৫ অগস্ট হলেও বৃষ্টির অভাবে রোয়া জমিরও প্রায় চার ভাগে চাষিরা ধানের চারা পুঁতেছেন বিস্তর দেরিতে। তাতেও ফলন মার খাওয়ার প্রভূত আশঙ্কা।
কৃষি দফতর এই খরিফে চালের উৎপাদন-লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছিল প্রায় ১ কোটি ৮ লক্ষ টন। প্রকৃত উৎপাদন ৯৫ লক্ষে নামলে এখনই খাদ্যসঙ্কটের সম্ভাবনা হয়তো নেই, কিন্তু তা ভবিষ্যৎ বিপদের ইঙ্গিতবাহী বলে বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন। ওঁদের মতে, আগামী বছরগুলোয় বৃষ্টির খামখেয়ালিপনা বাড়বে বই কমবে না। অথচ খরিফ চাষ প্রায় পুরোটাই বৃষ্টির উপরে নির্ভরশীল। রবি মরসুমে বোরো ধানের সুবাদে এ বার ঘাটতি মিটলেও টানা দু’-তিনটে মরসুম এমন চললে পরিস্থিতি ঘোরালো হতে বাধ্য। খরিফ-রবি মিলিয়ে ফি বছর পশ্চিমবঙ্গে চালের গড় উৎপাদন দেড়শো লক্ষ টন, যা কি না সর্বভারতীয় উৎপাদনের প্রায় ১৫%। বিশেষজ্ঞদের অনেকের আশঙ্কা, আগামী দু’-তিন বছরেও প্রকৃতি এমন প্রতিকূল থাকলে পশ্চিমবঙ্গ তার এই ‘শীর্ষস্থান’টি খোয়াতে পারে। সরকার কী বলছে?
রাজ্যের কৃষি-সচিব সুব্রত বিশ্বাস আশাবাদী। তাঁর বক্তব্য, “এটা ঠিক যে, আড়াই লক্ষ হেক্টরেরও বেশি জমিতে ধান চাষ করা গেল না। কিছু জায়গায় কৃষকেরা সময়ে ধান রুইতে পারেননি। তবে ধান রোয়ার পরে অধিকাংশ জায়গায় ধানগাছের বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় বৃষ্টি মিলেছে। ফলে ভাল কিছু আশা করা যেতেই পারে।” যদিও কৃষি-বিশেষজ্ঞ তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য রথীন্দ্রনারায়ণ বসুর মন্তব্য, “১৫ অগস্টের পরে ধান রোয়া যত পিছোবে, চাল উৎপাদন তত কমবে। দেরিতে রোয়া ধানগাছে এমনিতেই ফুল আসবে দেরিতে। সেই ধানের শীষ থেকে পরিণত দানা পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই।” এবং এরই ভিত্তিতে রথীন্দ্রবাবু মনে করেন, উৎপাদনে ঘাটতির অঙ্কটা দফতরের প্রাথমিক হিসেবকে ছাপিয়ে গেলেও আশ্চর্যের কিছু নেই। ২০১০-এ রাজ্যে খরা ঘোষিত হয়েছিল। সে বছর খরিফে ১ কোটি ৭ লক্ষ টন চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল কৃষি দফতর। উঠেছিল সাকুল্যে ৮৮ লক্ষ টন। রথীন্দ্রবাবু বলেন, “খরিফে ধান রুইতে দেরি হওয়ায় মাঠ থেকে ফসল কেটে ঘরে তুলতেও চাষির দেরি হবে। ফলে পরবর্তী ফসল বা বোরো ধান রোয়ার জন্য সময়মতো মাঠ খালি পাওয়া কঠিন। কাজেই বোরোর ফলনও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।”
কী ভাবে বেরোনো যেতে পারে এই সঙ্কট থেকে? রথীন্দ্রনারায়ণবাবুর দাওয়াই, “ফসলে বৈচিত্র্য এনে কিছুটা রেহাই মিলতে পারে।” অন্য দিকে মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর হরিহরপাড়া গ্রামের কৃষক সাদেক শেখ জানাচ্ছেন, “দেড় মাস অপেক্ষায় থেকে তার পরে বৃষ্টি পেয়ে অগস্টের শেষ সপ্তাহে দেড় বিঘেয় ধান রুইয়েছি। এমনিতে ১৫-১৬ মণ ফলন পাই। এ বার আট মণের বেশি হবে না।” সাদেকের আক্ষেপ, “জুলাইয়ের শেষে ধান রুইতে পারলে অবস্থা অনেক ভাল হতে পারত।”
সে সময় যখন পেরিয়ে গেল, তখন অন্য ফসলের চাষ করলেন না কেন? সাদেক বলেন, “আশায় ছিলাম, এই বৃষ্টি নামবে। ধান কম উঠলেও পেটের ভাত জোগানোর চালটা তো অন্তত কিনতে হবে না!”
|
খরিফ নামা |
সিঁদুরে মেঘ
•
দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি ঘাটতি ১৭%, উত্তরে ১০%
•
রাজ্যবাসীর বছরে চাল লাগে ১৪৫ লক্ষ টন
•
খরিফে এ বার উৎপাদন হবে ৯৫ লক্ষ টন
•
লক্ষ্যমাত্রায় তুলনায় ঘাটতি ১৩ লক্ষ টন
•
পর পর দু’মরসুম এমন চললে ভাঁড়ারে টান
•
বোরো চাষ মার খেলে এ বারেই টানাটানি
•
বোরো ধান হয় সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টন |
দাম বাড়তে পারে?
এখনই না। ভিন রাজ্যের উপরে
নির্ভরতা বাড়লে তখন। |
খারাপের মধ্যে ভাল
চাষিকে হয়তো অভাবী
বিক্রি করতে হবে না |
পরিত্রাণের পথ
•
সেচের আওতায় নতুন এলাকা
• বৃষ্টির জল ধরে সেচে ব্যবহার
• নিচু জমি ভরাট
• সর্ষে-ভুট্টার মতো বিকল্প চাষ |
খনার
বচন
আষাঢ়ের পঞ্চ দিনে। রোপণ করে ধানে॥
ডেকে ডেকে খনা গান। রোদে জলে হয় ধান॥
দিনে রোদ, রাতে জল। বাড়ে ধানের বল॥ |
|
|
|
 |
|
|