প্রচলিত ‘রীতি’তেই ঘা দিয়েছে নলহাটির বুজুং সমবায় কৃষি উন্নয়ন সমিতি। তৃণমূল, কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি, ফরওয়ার্ড ব্লক ও সমাজবাদী দল একজোট হয়ে ভুলেছে রাজনৈতিক ভেদ-বিভেদ। সমবায়ের পরিচালন সমিতিতে প্রতিনিধি নির্বাচন হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। পরিচালন বোর্ডও গঠিত হয়েছে সর্বসম্মত ভাবেই। কোনও বিবাদ ছাড়া।
অথচ উন্নয়নের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলির একজোট হওয়া এ রাজ্যে বড়ই বিরল। বরং উন্নয়নের প্রশ্নকে দূরে সরিয়ে রাজনৈতিক আকচাআকচি দেখতেই অভ্যস্ত পশ্চিমবঙ্গের আম-জনতা। সিঙ্গুরে টাটাদের ন্যানো গাড়ির কারখানা সেই প্রচলিত ‘রীতি’রই জ্বলন্ত উদাহরণ। এ রাজ্যে স্কুলভোটকে ঘিরেও রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়। রক্ত ঝরে। এমন রাজনৈতিক আবহে বীরভূম জেলার ওই কৃষি উন্নয়ন সমিতিটি সত্যিই ব্যতিক্রম। যেখানে উন্নয়নের স্বার্থে এবং রাজনৈতিক অশান্তি এড়াতে একজোট হয়ে ওই সমবায়ের নির্বাচন প্রক্রিয়া বাতিল করেছেন এলাকার রাজনৈতিক দলগুলি। ভোটের বদলে নেতাদের কাছে গুরুত্ব পেয়েছে বাস্তব পরিস্থিতি।
কী সেই উন্নয়ন আর কী রকমেরই বা একজোট?
ওই সমবায় সমিতির ম্যানেজার ডালিম পাল বলেন, “পরিচালন সমিতির নির্বাচনে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। তা ছাড়া রাজনৈতিক চাপানউতোরে নির্বাচন প্রক্রিয়া ঘিরে উত্তেজনাও ছড়ায়। এই পরিস্থিতিতে এলাকার সমস্ত রাজনৈতিক দল একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্বাচন করা হবে না। তার বদলে ওই টাকা সমবায়ের উন্নতিতে খরচ করা হবে।” ওই সমবায় এমনিতে রুগ্ণ নয় জানিয়েও তাঁর মন্তব্য, “ভোট বাবদ বেঁচে যাওয়া টাকা সমবায়ের উন্নতিতে খরচ হবে।”
সমবায় সূত্রে জানা গিয়েছে, নলহাটি থানার বুজুং, রামেশ্বরপুর, সরস্বতীপুর, রামপুর এই চারটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ওই কৃষি সমবায়ের সদস্য সংখ্যা ১৫২৬। ২৫ জন সদস্য পিছু এক জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ৬২ জন সদস্যের পরিচালন কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার কথা। ওই ৬২ জনের মধ্যে থেকে গঠিত হবে ৯ সদস্যের পরিচালন বোর্ড। কংগ্রেসের দখলে থাকা গত বোর্ডের মেয়াদ ফুরনোয় আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের দিন ঘোষিত হয়। ৩-৫ সেপ্টেম্বর মনোনয়নপত্র তোলা ও জমা দেওয়ার দিন।
কিন্তু, ১ তারিখই নিজেদের মধ্যে আলোচনায় রাজনৈতিক নেতারা ঠিক করেন, অনেক হয়েছে। এ বার আর ভোট হবে না। ফলে, ৬২টি আসনের জন্য কেবল ৬২টি মনোনয়নপত্রই জমা পড়ে! একটিও অতিরিক্ত জমা পড়েনি। কারা মনোনয়নপত্র জমা দেবেন, তা-ও আগাম ঠিক করা ছিল। “প্রতিদ্বন্দ্বিতাই যেখানে নেই, সেখানে ভোট হবে কী করে? এই কারণেই ওই সমবায়ে নির্বাচন হয়নি।” বলছেন সমবায় দফতরের নলহাটি ১ ব্লকের পরিদর্শক অনুপকুমার বসাক।
এর পরেই দলগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে রাজনৈতিক দলগুলি সর্বদল কমিটি গঠন করে বেছে নেয় ৬২ জন প্রতিনিধি। ৯ সদস্যের পরিচালন বোর্ডে কংগ্রেসের ২, বিজেপি-র ২, সমাজবাদী দলের ২, সিপিএমের ১ এবং ফরওয়ার্ড ব্লক ও তৃণমূলের ১ জন করে প্রতিনিধি রাখা হয়েছে। সংখ্যা কমবেশি হওয়া নিয়েও কোনও দলই তরজায় জড়ায়নি।
বুজুংয়ের মতো রাজনৈতিক ভাবে অস্থির একটি এলাকায় এই কাজ কিন্তু সহজ ছিল না। এমনিতেই বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক সংঘর্ষ লেগে থাকে। খুব সম্প্রতি কংগ্রেসের দখলে থাকা স্থানীয় বড়লা পঞ্চায়েতে প্রধানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থাকে ঘিরে রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়েছে বুজুং গ্রামে। ডালিমবাবু বলেন, “ওই সংঘর্ষের বাতাবরণে ভোটের পথে না হাঁটাই বাঞ্ছনীয় বলে সদস্যদের বোঝানো হয়। পাশাপাশি বেঁচে যাওয়া অর্থে সমবায়ের উন্নয়নের কথাও বলা হয়। তাতে সহমত হয়ে একসঙ্গে বসে গঠন করা হয় পরিচালন বোর্ড।”
কী বলছেন এলাকার রাজনৈতিক নেতৃত্ব?
কংগ্রেসের নেতা মহম্মদ কাজেম আলি বলেন, “সমবায় সমিতির মতো জায়গায় রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-জটিলতাকে ঠাঁই না দেওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। যার জন্য আমরা নির্বাচন করতে চাইনি।” সমবায়ের উন্নয়নের স্বার্থে মিলেজুলে কাজ করতে চেয়েছেন বিজেপি নেতা জগন্নাথ মালও। তাই এলাকায় নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব থাকা সত্ত্বেও তাঁরাও মত দেন নির্বাচন না করার পক্ষেই। সমাজবাদী দলের মহম্মদ জালালউদ্দিনের সংযোজন, “আমরা সবাই এক হলে এই সমবায়ের উন্নয়ন ঘটাতে চাই।” নিজেদের মাত্র এক জন করে প্রতিনিধি রাখা হলেও ক্ষোভ নেই তৃণমূল নেতা দীনবন্ধু মাল বা সিপিএম নেতা তপনকুমার মালের। দু’জনেই বললেন, “আমরা শুধু চাই এই সমবায়ের উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটুক। সমবায়ের মাধ্যমে প্রত্যেক চাষির ঘরে উন্নয়নের ফসল পৌঁছক।”
সর্বসম্মতির পরিচালন সমিতিএই ব্যবস্থা তাঁরা পাকাপাকি ভাবে চালু করতে চান। তবে, পুরোটাই নির্ভর করবে পরিস্থিতির উপরেজানাচ্ছেন দীনবন্ধুবাবু, কাজেম আলিরা। এলাকার চাষি তথা সমবায়টির সদস্য শ্যামল পাল বলেন, “আগে ভোট হলে অশান্তি হত। নতুন উদ্যোগকে আমরা তাই স্বাগত জানাচ্ছি।” রাজ্যের সমবায় মন্ত্রী হায়দার আজিজ সফির প্রতিক্রিয়া, “বুজুংয়ের এই সমবায় সম্পর্কে অবশ্যই খোঁজ নেব। পরে যখন বীরভূমে যাব, ওখানে একবার যাওয়ার ইচ্ছে রইল।”
কয়েকটা কম্পিউটার। নতুন আলমারি। জীর্ণ ক্যাশ কাউন্টার সংস্কার। ভোট না করে বাঁচানো টাকায় সমবায়ের পরিকাঠামোগত আধুনিকীকরণই আপাতত পরিকল্পনা। তার পরে চাষির মেঠোজীবনেও দিতে চান আধুনিক প্রযুক্তির ছোয়া। কী ভাবে? নতুন পরিচালন বোর্ড শীঘ্রই সেই আলোচনায় বসবে।
উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক মতভেদ ভুলে একজোট হওয়া। গুজরাত পারে। আমরা পারি না। এ তকমা পশ্চিবঙ্গের গায়ে সাঁটা। ছোট পরিসরে হলেও বুজুং দেখাল, সদিচ্ছা থাকলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। |