‘টোলগের আমাকে একটা ফোন করা উচিত ছিল’
|
সল্টলেকের বাড়ির একতলার লাউঞ্জে সোমবার বেশি রাতে কিছুটা রিল্যাক্সড তিনি।
আবার কখনও বেশ উত্তেজিত। ট্রেভর জেমস মর্গ্যান চলতি মরসুমে তাঁর
প্রথম একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন গৌতম ভট্টাচার্য-কে। |
প্রশ্ন: গল্ফ খেলেন তো আপনি?
মর্গ্যান: হ্যাঁ, খুব ভালবাসি।
প্রশ্ন: লোকে বলে গল্ফ নাকি সব রকম স্ট্রেস ভুলিয়ে দেয়। আপনার ক্ষেত্রে মনে হয় না সত্যি বলে। ইদানিং যখন খেলেন, টি-অফ করার পরে সেকেন্ড শটের দিকে হেঁটে যেতে যেতে ওই সবুজের মধ্যে নিশ্চয়ই ওডাফা-টোলগেকে দেখতে পান! ওয়ান-টু খেলে ওরা ইস্টবেঙ্গল গোলের কাছে চলে আসছে।
মর্গ্যান: আরে না না (হাসি)। আমি ওদের মোটেও দেখি না। গল্ফ সত্যিই এমন একটা জিনিস যা সব কিছু ভুলিয়ে দেয়। আমার মনেই থাকে না। গল্ফের সবচেয়ে বড় জিনিস হল সব কিছু সমান লেভেলে। হ্যান্ডিক্যাপ থাকার জন্য সবাই এক জায়গা থেকে শুরু করতে পারে। টি-অফের পর যখন হাঁটতে শুরু করি সবুজের মধ্যে দিয়ে, তখন আর মাথায় অন্য কিছু থাকে না। এটা একটা দারুণ রিলিজ। আমি তখন দশ লাখের মধ্যে একজন। নিছকই একজন গল্ফপ্রেমী। ইস্টবেঙ্গল কোচ-টোচ কিছু নই। রিল্যাক্সেশনের জন্য গল্ফ একেবারে অব্যর্থ দাওয়াই।
প্রশ্ন: কী বলছেন? টেনশনের এই বাজারে এতটা লম্বা হাঁটতে হাঁটতে আপনি ভুলে যান যে ইস্টবেঙ্গল কোচ? সম্ভব নাকি যে লাল-হলুদ দেখতে পান না?
মর্গ্যান: সামটাইম্স ইয়েস। মনে পড়ে বটে। যখন ফ্ল্যাগগুলোকে দেখতে পাই। সামনের দিকটা লাল থাকে। পেছনটা সবুজ। এর বাইরে ফোন-টোন সব থাকে বন্ধ। আর যাদের সঙ্গে খেলি তারা প্রিয়জনই হয়। সুতরাং বিশ্বসংসার থেকে অনেকটা আলাদা থাকা যায়।
প্রশ্ন: তা হলে টোলগে আর ওডাফার ওয়ান-টু খেলার কথা কখন ভাবেন? ইস্টবেঙ্গল টেন্টে যাওয়ার পথে?
মর্গ্যান: নট অ্যাট অল। ভাবিই না। বরঞ্চ ইডেন গার্ডেন্স ডান দিকে রেখে যখন ঢুকি, তখন ভাবতে ভাবতে যাই ইংল্যান্ড এলে এখানে বসে টেস্ট ম্যাচ দেখব।
প্রশ্ন: টোলগে ড্যাংড্যাং করে চলে গেলেন মোহনবাগানে। শোনা যাচ্ছে চতুর্থ বিদেশিকেও কেনার টাকা নেই ইস্টবেঙ্গলের। তা হলে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকরা কোন আশায় বুক বাঁধবে? কীসের দিকে এগিয়ে থাকবে?
মর্গ্যান: তাকিয়ে থাকবে একটা ভাল টিমের দিকে। যারা যথেষ্ট সঙ্ঘবদ্ধ। যারা এ বার ভাল ফুটবল খেলতে মরিয়া। আর একটা কথা বলি। চিডি মোটেও টোলগের বিকল্প না। চিডিকে প্রথম যবে দেখি তবে থেকেই মনে ধরেছিল। আমার সব সময়ই ওকে ভাল লাগত। কিন্তু আগে ওকে নিতে পারিনি।
প্রশ্ন: চিডি কি টোলগের চেয়ে ভাল?
মর্গ্যান: দু’জনে দু’ধরনের। এ যদি ফ্র্যাঙ্ক সিনাত্রা হয়, তা হলে ও... ও হল গিয়ে...
প্রশ্ন: এলটন জন?
মর্গ্যান: ইয়েস, এলটন জন। টোলগে ইস্টবেঙ্গলের জন্য অনেক কিছু করেছে। গত দু’বছর ও-ই ছিল হায়েস্ট স্কোরার। তার পর ও ঠিক করল দল বদলাবে। সেটাই জীবন। ইট্স আ ফ্রি কান্ট্রি। যে যা করতে চায় তাকে সেটা করতে দেওয়া উচিত। কিন্তু যেটা গণ্ডগোল হয়ে গেল, সেটা হল টাইমিং। টাইমিংটাই যেন একটা চোনা ফেলে দিল। যেমন আমরা লিগ জিতে ওঠার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে টোলগে চলে গেল মোহনবাগানের হয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করতে। ওদের দিক দিয়ে দারুণ। কিন্তু এই জিনিসটাই যদি দু’তিন সপ্তাহ পরে ঘটত, তা হলে বোধহয় প্রতিক্রিয়াটা এ রকম হত না।
প্রশ্ন: কিন্তু টোলগের বাবা তো আপনাকে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন ব্যাপারটা মিটিয়ে দিতে।
মর্গ্যান: ঠিকই। আমায় ফোন করেছিলেন। ফোন করে বলেছিলেন কোচ হিসেবে আমি ব্যাপারটার ফয়সালা করতে পারি কি না। আমি বলি আমি তো আমার মতামত দিয়েই দিয়েছি। ওর বাবা তখন বলেন, ট্রেভর তুমি কেন ক্লাবকে ফোন করে বলছ না টোলগেকে ছেড়ে দিতে। আমি বলি সেটা কী করে সম্ভব? আমি একটু হতাশ-ই যে, টোলগের সঙ্গে আমার তো যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক ছিল গত বছর। তা হলে ও কেন আমাকে ফোন করে সরাসরি বলল না? বাবা কথা বলার পরেও তো ও কথা বলতে পারত। জানি না ওর বাবার সঙ্গে আমার কথাটা কী ভাবে ওর কাছে পেশ হয়েছে। কোনও ইম্পর্ট্যান্ট সেন্টেন্স বাদ চলে গেছে কি না? কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে কি না?
প্রশ্ন: টোলগের ব্যাপারে আপনার মতামতটা কী ছিল?
মর্গ্যান: সবাই জানে সেটা। আমি বলেছিলাম ও আমাদের হয়ে ভাল খেলেছে। এ বার ও সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোহনবাগানে যাবে। ওকে ছেড়ে দেওয়া উচিত। আমার তো মনে হয় একশো জনের মধ্যে শতকরা নিরানব্বই জনই টোলগে যা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা-ই নিত। সিদ্ধান্তটা কী, না যে খেলাটা খেলতে ও সবচেয়ে ভালবাসে সেই ফুটবল খেলে যাওয়া। আর বেশি টাকা রোজগার করা। ওর জায়গায় সবাই তাই করত। আমি টোকেন-ফোকেন জানি না। সেটা ক্লাব ভাল জানে। আমি কেবল এটুকু বুঝি, চুক্তি শেষ মানে আপনি ফাঁকা।
আমার শুধু একটাই খারাপ লাগে। ওর বাবার সঙ্গে যা-ই কথা হোক, টোলগের আমাকে একটা ফোন করা উচিত ছিল।
প্রশ্ন: ভেবে খারাপ লাগেনি যে এই ছেলেটাকে আমিই ময়দানে আনলাম। বড় করলাম। তার পর সে কিনা আমাকে ছেড়ে চলে গেল?
মর্গ্যান: দ্যাট্স লাইফ। প্রত্যেকটা সম্পর্কেরই একটা চূড়ান্ত গতিপথ থাকে। আমরা দু’বছর একসঙ্গে ছিলাম। তারপর সেখান থেকে দু’জনেই যে যার মতো এগিয়ে গেছি। আমিও গেছি, ও-ও গেছে। আর ফিরে তাকানোর মানে হয় না।
প্রশ্ন: কলকাতা ময়দানের সেরা ফুটবলার কে? টোলগে?
মর্গ্যান: (হাসি) বলা খুব মুশকিল এ ভাবে। তবে আমার ওডাফাকে দারুণ লাগে। গোল-স্কোরার হিসেবে ওর জবাব নেই। হাফ চান্স পেলেও গোল করে। সচরাচর মিস করে না। তবে আমার খুব পছন্দ সেই সব ফুটবলারদের যারা খেলাটা তৈরি করে। স্ট্রাইকাররা খ্যাতি নিয়ে যায়, কিন্তু তার পিছনে যারা তাদের সাপোর্ট করে তারা যতই আড়ালে থাকুক, আমার খুব প্রিয়। টোলগে গত মরসুমে ভাল খেলেছিল। কিন্তু ওকে বলটা যুগিয়েছিল মিডফিল্ডাররা। পেন যেমন। খাবড়া যেমন। তবে এক নম্বর যদি কাউকে বাছতে হয়, তা হলে সেটা বোধহয় র্যান্টি মার্টিন্স। গত চার বছরে ও হায়েস্ট স্কোরার। টিমের জন্য সব সময় খেলে। র্যান্টিকে কখনও আমি কিছু নিয়ে অভিযোগ করতে দেখিনি। আমি কিছুটা অবাক ও ডেম্পো ছেড়ে প্রয়াগে চলে আসায়।
প্রশ্ন: র্যান্টি সম্পর্কে তা হলে আপনি কখনও আগ্রহ দেখাননি কেন?
মর্গ্যান: (চোখ তুলে অর্থপূর্ণ ভঙ্গি) আগ্রহ দেখাইনি আপনাকে কে বলল?
প্রশ্ন: শোনা যায় ইস্টবেঙ্গল র্যান্টিকে প্রায় পেয়ে গেছিল। আমি যাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছি কর্মকর্তারা তাঁর অনুমোদন পাননি। কথাটা সত্যি নয়?
মর্গ্যান: সত্যি নয়।
|
প্রশ্ন: ফেডারেশন কাপের ফেভারিট প্রথম তিনটে টিম বেছে দিন।
মর্গ্যান: এই রে। প্রথম তিনটে টিম না প্রথম চারটে টিম? যারা সেমিফাইনাল খেলবে।
প্রশ্ন: প্রথম তিনটে টিম। আর কেন বাছছেন কারণ বলতে হবে।
মর্গ্যান: প্রথম ইস্টবেঙ্গল। কোনও ব্যাখ্যায় যেতে চাই না। আমার টিমের ওপর তো নিজের আশা থাকবেই।
দুই মোহনবাগান। টোলগে আর ওডাফা পার্টনারশিপটা নিশ্চয়ই ওদের সম্পদ। দু’জনে মিলে ষাটের ওপর গোল করছে গতবার আই লিগে। দারুণ স্ট্রাইকিং কম্বিনেশন।
তিন ডেম্পো। ওরা ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলে আসছে। তবে ইন্টারেস্টিং হবে, র্যান্টি ছাড়া ওরা কেমন খেলে।
প্রশ্ন: আপনার সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের গভীর মতভেদের খবর প্রায়ই জানাজানি হয়। টোলগের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ভেঙে গেল। কলকাতা মিডিয়াও আপনাকে মোটেই পছন্দ করে না। কী ভাবে পরিচয় করাবেন এই ট্রেভর জেমস মর্গ্যানের?
মর্গ্যান: আমি নিজেকে পরিচয় করাতেই চাই না। আমি কেয়ারই করি না অন্য কেউ আমাকে নিয়ে কী ভাবছে। আমি চাই নিজের কাজটা সৎ ভাবে, নিষ্ঠার সঙ্গে করতে। আমি মনে করি আমার চাকরির শর্ত হল লোকে আমার কাছে পেশাদার মতামত জানতে চাইবে। আমার কাজ হল সেটা পরিষ্কার করে দেওয়া। সেটা শুনতে যত কর্কশই লাগুক, আমার কিছু আসে-যায় না।
প্রশ্ন: কিন্তু মিডিয়ার সঙ্গে আপনার মতো গণ্ডগোল তো কোনও কোচের হয়নি। মাঝখানে তো আপনি অনুশীলনে মিডিয়াকে ঢুকতেই দিচ্ছিলেন না। যা কলকাতা ফুটবলে নজিরবিহীন।
মর্গ্যান: দেখুন ভাই, আমার কাজ হল আমার টিমকে, আমার প্লেয়ারকে প্রোটেক্ট করা। সেটা করতে গিয়ে আমায় যদি রুক্ষ এবং অপ্রিয় হতে হয়, আমার কিছু আসে-যায় না। গণ্ডগোলটা বাধে প্র্যাক্টিসে আমার দুই প্লেয়ারের মধ্যে ঝামেলা নিয়ে। এই ধরনের ঝামেলা, ছোটখাটো মারপিট বিশ্বের সব ফুটবল মাঠে ৩৬৫ দিন চলে। আমায় যদি অনুশীলনের প্রত্যেকটা মিনিট মিডিয়ার জন্য খুলে দিতে হয়, আর সেখানে হওয়া এ সব খুচখাচ ঝামেলা যদি তারা টিভি চ্যানেলে দেখাতে থাকে বারবার করে, তা হলে তো আমার টিম চলবে না। মনে করুন মোহনবাগান ম্যাচের আগে আমি ফ্রি-কিক প্র্যাক্টিস করাচ্ছি। সেটপিস মুভমেন্ট করাচ্ছি। সবই যদি টিভি ক্যামেরা তুলে নেয়, তা হলে তো সবাই সব কিছু পেয়ে যাবে। টোলগে আর গুরবিন্দরে যখন গত বছর প্র্যাক্টিসে খুব নর্ম্যাল একটা ঝামেলা হল, আমি মিডিয়াকে অনুরোধ করলাম আপনারা প্লিজ এটা দেখাবেন না। ওরা ঠিক সেটাই দেখাল বারবার করে। আমি সিওর এ বার মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের আগে ছবিটা ওরা বারবার করে দেখাবে।
প্রশ্ন: কিন্তু ক্লাব কর্তারা তো আপনার সঙ্গে একমত ছিলেন না। তাঁরা তো উল্টো চাপ দিচ্ছিলেন, মিডিয়াকে ঢুকতে দাও।
মর্গ্যান: আমি যখন ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রথম নিই তখন ওরা একমতই ছিল। এ বার ওঁরা আমায় জিজ্ঞেস করেন মিডিয়া ঢুকতে দিলে আমার কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে কি না? আমি তখন বলি, ঠিক আছে অ্যালাউ করো। কিন্তু ওই যে বললাম, বছরের প্রতিটা দিন প্রতিটা মিনিট যদি মিডিয়ার কাছে সবই চলে যায় তা হলে আপনি গোপন কিছু তৈরি করবেন কী করে?
প্রশ্ন: দিনের শেষে তা হলে কী দাঁড়াল? ট্রেভর জেমস মর্গ্যান তা হলে ময়দানের সেই মানুষ, যাকে লোকে সবচেয়ে বেশি ভুল বোঝে।
মর্গ্যান: ভুল বোঝে কি না আমার জানার দরকার নেই। এটা অন্য লোকে বলতে পারবে। ওরা বিচার করবে। আমার কাজ সৎ ভাবে, নিষ্ঠা ভরে টিম চালানো। ক্লাব সমর্থন কাকে বলে আমি বুঝি। আমাদের বাড়িতে আমরা নিজেরা ওয়েস্টহ্যামের পাগল সাপোর্টার। আমার বয়স আজ ৫৫। এই বয়সেও শুক্রবার ওয়েস্টহ্যাম একটা ম্যাচ জিতলে আমাদের গোটা উইকএন্ড ভাল যায়। আমার দায়িত্ব সে ভাবে ইস্টবেঙ্গল সাপোর্টারদের বছরের অর্ধেক দিন খুশিতে রাখা। সেটা করতে গিয়ে কে কী ভাবল, কে কী বলল আমার কিচ্ছু এসে-যায় না। |