গ্র্যান্ড স্ল্যাম কী ভাবে জিততে হয়, লেন্ডলই শিখিয়েছে মারেকে
|
লন্ডনে মাস দুই আগে থাকার সময় অ্যান্ডি মারেকে উইম্বলডন খেলতে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। একটু-আধটু টেনিস খেলার সুবাদে তখনই মনে হয়েছিল, অবশেষে ওর মধ্যে সেই জোশটা তৈরি হয়েছে, যেটার অভাবে বতর্মান সার্কিটের অন্যতম সেরা প্লেয়ার হওয়া সত্ত্বেও গ্র্যান্ড স্ল্যামের চূড়ান্ত ধাপটা পেরোতে পারেনি এত দিনেও। যে জোশটা এক জন খুব ভাল প্লেয়ারের সঙ্গে চ্যাম্পিয়নের পার্থক্য করে দেয়। উইম্বলডন ফাইনালেও মারে হেরেছিল কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে উইম্বলডনেই অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে বুঝিয়ে দেয়, ওকে নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণ ঠিক। আগে চারবার তীরে এসে তরী ডুবলেও জীবনের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম পাওয়া মারের কাছে ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা।
|
মারে-ইতিহাস |
• ৪ ঘণ্টা ৫৪ মিনিটের ফাইনাল। যুক্তরাষ্ট্র ওপেনের ইতিহাসে দ্বিতীয় দীর্ঘতম। • টুর্নামেন্টের ইতিহাসের সবচেয়ে উত্থান-পতনের ফাইনাল। যেখানে একটি র্যালিতে ৫৪টি শট খেলা হয়েছে। ৩০ শটের র্যালি হয়েছে একাধিক।
• গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালের ইতিহাসে দীর্ঘতম টাইব্রেকার। প্রথম সেটে ওই ২৪ মিনিটব্যাপী টাইব্রেকে মারে ষষ্ঠ সেট পয়েন্টে জেতেন ১২-১০।
• মারে এর আগে চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনাল মিলিয়ে মাত্র একটি সেট জিতেছিলেন।
• শেষ ৩১টি গ্র্যান্ড স্ল্যামের মধ্যে ২০১২ যুক্তরাষ্ট্র ওপেন মাত্র দ্বিতীয় খেতাব যেটা ফেডেরার-নাদাল-জকোভিচ, ত্রয়ীর বাইরে কেউ জিতলেন।
• গ্র্যান্ড স্ল্যামের ওপেন যুগে প্রথম ব্রিটিশ প্লেয়ার হিসেবে খেতাব জয় মারের। সব মিলিয়ে ৭৬ বছর পর কোনও ব্রিটিশ টেনিস তারকার গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব। |
|
এবং কী ঐতিহাসিকই না ছ’ফুট তিন ইঞ্চি, বছর পঁচিশের স্কটের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম খেতাব! মারের আগে শেষ ব্রিটিশ টেনিস প্লেয়ারের গ্র্যান্ড স্লাম জয় ৭৬ বছর আগে। যে বছর স্পেনে গৃহযুদ্ধ শুরু আর রুজভেল্ট আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে পুনর্নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩৬। সে বছরই ফ্রেড পেরি তৃতীয়বার যুক্তরাষ্ট্র ওপেন জেতেন। সোমবার মধ্যরাতে ফ্লাশিং মেডোয় মারকাটারি ফাইনালে গতবারের চ্যাম্পিয়ন জকোভিচকে পাঁচ সেটের ম্যারাথন লড়াইয়ে ৭-৬ (১২-১০), ৭-৫, ২-৬, ৩-৬, ৬-২ হারানোর পর মারে ঠিকই বলেছে যে, ও কবে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতবে এই প্রশ্নটা ওকে আর তাড়া করবে না ভেবে ওর দারুণ স্বস্তি লাগছে। আরও একটা সত্যি কথা বলেছে। ‘‘পঞ্চম সেটে যখন ম্যাচ জেতার জন্য সার্ভিস শুরু করছি, ভীষণ ভাবে অনুভব করছিলাম ব্রিটিশ টেনিসের পক্ষে এই মুহূর্তটার কী অপরিসীম গুরুত্ব।”
আগের মারে হলে আমি নিশ্চিত পঞ্চম সেটে ও ওই ভাবে ৪-০ এগিয়ে যেতে পারত না। কিংবা পঞ্চম গেমে নিজের সার্ভিস নষ্ট করার পরের গেমেই আবার জকোভিচের সার্ভিস ভাঙতে পারত না। জকোভিচ তার আগের দুটো সেট সত্যিই দুর্ধর্ষ খেলেছে। ০-২ সেট পিছিয়ে থাকার চাপ নিয়েও। জকোভিচের কিছুটা দুর্ভাগ্য যে, চূড়ান্ত সেটে পায়ের মাসল পুলের জন্য ওকে কোর্টে ডাক্তারের সাহায্য নিতে হয়। সে জন্য অবশ্য মারের কৃতিত্ব এতটুকুও কমছে না। কারণ আমার মতে প্রথম সেটের টাইব্রেকারটা ফাইনালের টার্নিংপয়েন্ট। একটা সেট শেষ হতেই দেড় ঘণ্টা লেগে যায়। আর মারে ও রকম একটা সেট জেতায় আরও আত্মবিশ্বাসী, জমাট, সাহসী হয়ে উঠেছিল।
মারের মধ্যে অবশ্য এ সব গুণাবলীর বৃদ্ধি ওর বর্তমান ট্যুর কোচ ইভান লেন্ডলের জন্যই। লেন্ডল নিজে ১৯৮৫-’৮৭ টানা তিন বার যুক্তরাষ্ট্র ওপেন পাওয়ার আগের তিন বার ফাইনালে হেরেছিল। ফলে খুব ভাল করে জানে গ্র্যান্ড স্ল্যাম ফাইনালে জেতার জন্য কী কী করতে হয়। কী ভাবে অনন্ত চাপের মুখে স্নায়ুতন্ত্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়। মারের জেতা ফাইনালটা যুক্তরাষ্ট্র ওপেনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম ফাইনাল। আর কী আশ্চর্য! ফ্লাশিং মেডোয় দীর্ঘতম ফাইনাল খেলার নজির মারের কোচেরই। অষ্টাশির সেই ফাইনালে লেন্ডল যদিও হেরেছিল ভিল্যান্ডারের কাছে। |
লেন্ডল টেনিসের এক জন গ্রেট উইনার। মারের মধ্যে আশা করি যে জিনিসটা এর পরে দেখা যাবে। একটা জিতেছে যখন, তখন আরও অনেক গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতবে। ঠিক ওর গুরুর মতোই। নইলে এমনিতে মারেকে আমার এত দিন মনে হত, লেটন হিউইটের আরও ভাল সংস্করণ। টেনিসে এদের কাউন্টার পাঞ্চার বলে। মূলত রক্ষণাত্মক প্লেয়ার। ব্যাকহ্যান্ড দুর্ধর্ষ। লেন্ডলের কোচিংয়ে মারের ফোরহ্যান্ডও এখন বিশ্বমানের।
যার ফলে সামনের এক-দু’বছর বিশ্ব টেনিসে মারে বনাম জকোভিচ লড়াইয়ের টিআরপি-ই সবচেয়ে বেশি থাকবে। ফেডেরারের বয়স আর নাদালের চোট ওই দুই মেগাস্টারকে আর ধারাবাহিক ভাল খেলতে দেবে বলে আমার মনে হয় না। ওই একটা রোলাঁ গারো বা একটা উইম্বলডনে হয়তো জ্বলে উঠবে। কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইটা মারে আর জকোভিচেই আপাতত সীমাবদ্ধ থাকছে। |