|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
তা হলে কি বর্ষা কম হলেই ডেঙ্গি হবে? |
না কি এ বার সরকার চোখ ফেরাবে জনস্বাস্থ্যের ভগ্নদশার দিকে?
আর কতগুলো
প্রাণের মূল্যে বুঝতে হবে,
মশা কমাতে না পারলে দামি নার্সিং হোমও
বাঁচাতে
পারবে না আমাদের? এ রাজ্যের শহরে স্বাস্থ্যের সংকট কোথায়, লিখছেন অরিজিতা দত্ত |
হাসপাতাল থেকে মহাকরণ, স্বাস্থ্য ভবন থেকে পুরসভা, পশ্চিমবঙ্গে সর্বত্র চাপান-উতোরের কেন্দ্রে ডেঙ্গি। এ বছর কত জন আক্রান্ত, কত জন মারা গিয়েছেন ডেঙ্গিতে, তা নিয়ে তর্ক চলছে। তবু পরিসংখ্যান ছাড়াই বোধহয় এটা বলা চলে যে, এত দ্রুত, ব্যাপক এবং ঝুঁকিপূর্ণ সংক্রমণ সম্প্রতি আমরা আর কোনও রোগের দেখিনি। কী করে কলকাতায় এ বছর এমন ভয়ানক আকার নিল ডেঙ্গি?
সরকার পক্ষ মনে করছেন বৃষ্টির অভাব আর জনসাধারণের অজ্ঞানতাই মূলত এই সমস্যার জন্য দায়ী। দু’টি কথাই অকাট্য। এ কথাও ঠিক যে, আমরা সাধারণ মানুষরা, বিশেষত শিক্ষিত মানুষরা ডেঙ্গি বিস্তারে যথেষ্ট সাহায্য করেছি। ফুলদানিতে জল এক মাস ফেলে রাখা বা বাগানে জমা জলের নিকাশির ব্যবস্থা না করার ফল মশার বংশবৃদ্ধি। জুলাই-অগস্টের আবহাওয়া তাদের বংশবৃদ্ধিতে সহায়ক ছিল, তা-ও ঠিক। তবু আরও কয়েকটা তথ্য নিয়ে আলোচনা না করলেই নয়।
প্রথমত, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, ফাইলেরিয়া বা চিকুনগুনিয়ার মতো মশাবাহিত রোগগুলির প্রতিরোধের জন্য যে জনস্বাস্থ্যমুখী পরিকল্পনাটি কাজ করে এ দেশে (National Vector Borne Disease Control Programme, সংক্ষেপে NVBDCP), তা জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পের (NRHM) অধীনে কাজ করে। NVBDCP-র ওয়েবসাইট বলছে, ডেঙ্গি মূলত শহুরে অসুখ। নগরায়ণের ফলে শৌচালয় ও নিকাশি ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে শহরের আনাচে-কানাচে এই রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এটা লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, অধিকাংশ সংক্রামক অসুখ অনুন্নত রাজ্যগুলিতে বেশি হলেও, ডেঙ্গির আক্রমণ বেশি দেখা যায় পঞ্জাব, তামিল নাড়ু, গুজরাত, মহারাষ্ট্রের মতো উন্নত রাজ্যে। এ সব রাজ্যে শিল্পায়ন বেশি, নগরায়ণও বেশি।
অথচ এই রোগের মোকাবিলায় ভারত সরকার প্রধানত আস্থা রাখেন আশা কর্মী এবং নানা শ্রেণির গ্রামীণ স্বাস্থ্য কর্মীদের উপরে। এ থেকে সামনে আসে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার স্ববিরোধিতা। ডেঙ্গি মূলত শহুরে রোগ, কিন্তু তার প্রতিরোধ ও চিকিৎসার দায়িত্ব পেয়েছে জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন। প্রকল্পের নামই বলে দেয় যে তার কর্মভূমি প্রধানত গ্রামীণ অঞ্চল। জনসংযোগ রাখেন যে স্বাস্থ্যকর্মীরা, তাঁরাও গ্রামীণ অঞ্চলে মানুষের মধ্যেই সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারেন, রোগ প্রতিরোধ করতে পারেন। তা হলে ঘিঞ্জি শহরাঞ্চলে কী হবে? শহরগুলোতে পতঙ্গবাহিত রোগের মোকাবিলায় পরিকাঠামো দুর্বল, বরাদ্দ অর্থ ও কর্মীর অভাব সেখানে স্পষ্ট। দুর্বলতর পুরসভাগুলোতে পুরো সময়ের মেডিক্যাল অফিসার অতি সামান্য, জনসংখ্যার নিরিখে চিকিৎসক, স্বাস্থ্য কর্মী অপ্রতুল। তাই রোগের নিয়মিত নজরদারি-পরিদর্শনের প্রায় কিছুই হয় না। পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগগুলোর মূল মনোযোগ থাকে চিকিৎসার উপর। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষার ভিত্তিতে রোগচিত্রের বার্ষিক রিপোর্ট, সাধারণ রোগের পর্যবেক্ষণ কিংবা শহরের নানা এলাকায় পতঙ্গের প্রাদুর্ভাবের উপর নজরদারি, এগুলো গ্রামের তুলনায় শহরে দুর্বল। |
|
রোগের রাজনীতি। জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করা কোনও রাজনৈতিক দলই ‘লাভজনক’ মনে করে না। |
সেই দুর্বলতা প্রতিফলিত হয় বরাদ্দ অর্থের খরচে অক্ষমতাতেও। শহরাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য পরিষেবা দেবার মূল দায়িত্ব আসলে ন্যস্ত থাকে পুরসভাগুলির উপর। পুরসভার ক্লিনিকগুলিতে টীকাদান থেকে শুরু করে রক্ত পরীক্ষা সব হবার কথা। সঙ্গে জঞ্জাল পরিষ্কার, নিকাশি ব্যবস্থা বা মশা মারার ওষুধ ছড়ানো সব কিছুর দায়িত্বেও থাকে পুরসভা। ২০১২-১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাজেটে নগর স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য বরাদ্দ হয়েছে যা টাকা, তার মধ্যে মাত্র ৩৪ লক্ষ টাকা এসেছে স্বাস্থ্য দফতর থেকে, আর ৪৫ কোটি টাকা এসেছে নগরোন্নয়ন মন্ত্রক থেকে। কিন্তু তার বণ্টন নিয়েও সমস্যা রয়েছে -- রিপোর্ট বলছে, এ রাজ্যে মোট বরাদ্দের এক-চতুর্থাংশই চলে যাচ্ছে মাত্র পাঁচটি পুরসভায়। বহু পুরসভা স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাচ্ছে না।
এ বার দেখা যাক কলকাতা পুরসভার অবস্থা। জনসংখ্যার নিরিখে পৃথিবীর নবম বৃহত্তম শহর কলকাতা জনসংখ্যার ঘনত্বে ভারতের মধ্যে প্রথম প্রতি বর্গ কিলোমিটার জমিতে থাকেন সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি মানুষ। ২০১১-১২-এর তথ্য অনুযায়ী কলকাতা শহরের ৬৩ শতাংশ বাড়িতে জলের জোগান আছে আর প্রতিদিন মাথাপিছু কলকাতাবাসী ৪৩ লিটার জল পায়, যেখানে ন্যূনতম প্রয়োজন ১৩৫ লিটার (সূত্র: www.asci.org.in)। জঞ্জাল সরানো হয় মাত্র ২৫ শতাংশ বাড়ি থেকে, যেখানে মুম্বইতে হয় ১০০ শতাংশ! কলকাতায় পুরসভার মাতৃসদন আছে মাত্র পাঁচটি, রক্তপরীক্ষা কেন্দ্র ৪২টি। অনেকগুলি কেন্দ্রেই ডাক্তার বা স্বাস্থ্যকর্মী নেই। কলকাতা পুরসভার পক্ষ থেকে তাদের আয়-ব্যয়ের প্রায় কোনও হিসাবই জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করে না। তাই স্বাস্থ্য খাতে এবং বিশেষ করে মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে পুরসভা কতটা খরচ করতে পারত, এবং বাস্তবিক কতটা করেছে, তা বোঝার কোনও উপায় নেই।
পুরসভার বাইরে জনস্বাস্থ্যের দেখভাল করে প্রধানত স্বাস্থ্য দফতর। সমস্যা হল, জনস্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ অর্থ স্বাস্থ্য বাজেটের দশ শতাংশও নয়। আর সেই অনুপাত আরও নিম্নমুখী, গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্য বাজেটে জনস্বাস্থ্যের জন্য ০.২৫ শতাংশ বিন্দু বরাদ্দ কমেছে। এটাই যথেষ্ট দুর্ভাবনার কারণ, কিন্তু রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত হতে হয় যখন দেখি যে সেই সামান্য বরাদ্দও খরচ হচ্ছে না।
জনস্বাস্থ্য ও রোগ পর্যবেক্ষণের জন্য ২০১০-১১ সালের বাজেট বরাদ্দের ১৩ শতাংশ পড়ে রয়েছে। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের অধীনেও রোগ পর্যবেক্ষণ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য প্রচুর বরাদ্দ থাকে। ২০০৯-১০-এর তথ্য অনুসারে, সেই টাকার ৯৫ শতাংশ ছিল অব্যবহৃত। পতঙ্গবাহিত রোগ নিবারণ প্রকল্পের বরাদ্দেরও ১৬ শতাংশ রয়ে গিয়েছিল অব্যবহৃত। এ বছরের তথ্য এখনও প্রকাশিত হয়নি। এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, রোগ হবার আগে রোগ প্রতিরোধে গুরুত্ব এ দেশের ও এই রাজ্যের সরকার কম দিয়েছে। ‘স্বাস্থ্য ব্যবস্থা’ মানে দাঁড়িয়ে গিয়েছে ‘চিকিৎসা ব্যবস্থা।’ ডেঙ্গি কিন্তু প্রমাণ করল যে, বেসরকারি হাসপাতালে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে চিকিৎসা করালেও জনস্বাস্থ্যের ফাঁক পূর্ণ করা যায় না। সরকার এবং সাধারণ মানুষ চিকিৎসার খরচের নিরিখে, এবং অসুস্থতার জন্য হারানো রোজগারের নিরিখে, এ বছর যত টাকার ক্ষতি স্বীকার করেছেন, তার অতি সামান্য অংশ খরচ করলে যথেষ্ট জনস্বাস্থ্য কর্মী নিযুক্ত করে মশা প্রতিরোধ করে, রোগ প্রতিরোধ করা যেত। পাঁচটি প্রাণ হারিয়ে সুপরিকল্পনার অভাবের খেসারত দিতে হত না রাজ্যবাসীকে।
কেন এত অবহেলিত জনস্বাস্থ্য? তার কারণ, রোগ না-হলে নেতারা কেউ বাহবা পান না। গত বছর যখন এত মানুষ ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হননি, তখন সেই সাফল্য নিয়ে কেউ কথা বলেননি, টিভিতে টক-শো হয়নি, মুখ্যমন্ত্রীকে কোনও সংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। আর ঠিক এই জন্যই গণভোটে নির্বাচিত সরকারের কাছে জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করাটা খুব ‘লাভজনক’ নয়। ভারতে স্বাধীনতা-উত্তর যুগে জনস্বাস্থ্য সীমিত থেকেছে পরিবার পরিকল্পনা ও টীকাকরণের মধ্যে। রোগ প্রতিরোধ, উন্নত পানীয় জল ও শৌচালয়ের ব্যবস্থা, জঞ্জাল সাফ রাখা, দূষণ নিয়ন্ত্রণের মতো জনস্বাস্থ্যের কাজ সরকারের কাছে জরুরি হয়ে উঠতে পারেনি। বামফ্রন্ট সরকার জনস্বাস্থ্যের দুর্বলতার জন্য বার বার মহামারি-সদৃশ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েও সমাধানে উদাসীন থেকেছে। বর্তমান সরকারও আবহাওয়াকে দুষে দায় সেরেছে।
কিন্তু নাগরিকরা? কেন আমরা সারা বছর উদাসীন থাকি পারিপার্শ্বিক জনস্বাস্থ্য নিয়ে? আসলে আমরা, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত (সঙ্গে উচ্চবিত্তও বটে) সমাজ জানি যে, সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হলে হাতের কাছে প্রাইভেট ডাক্তারবাবু আছেন, অ্যান্টিবায়োটিকের জোগান আছে, প্রয়োজনে নার্সিং হোম আছে। ঘরে ওয়াটার পিউরিফায়ার আছে, সুইচবোর্ডে মশা-তাড়ানো যন্ত্র লাগানো আছে, মশা-বিকর্ষণ মলম আছে। সরকার টাকা খরচ করুক ‘ব্যক্তিগত’ স্বাস্থ্য পরিষেবার জন্য, ‘সমষ্টিগত’ জনস্বাস্থ্যে নয়। তাই নাগরিক সমাজ মুখর হয় না প্রতিবাদে, যতক্ষণ না ম্যালেরিয়া ডেঙ্গি একটা মহামারীর আকার নেয়। প্রতি বছর ডেঙ্গিতে যত মানুষ এ দেশে মারা যায়, তার কয়েক গুণ বেশি মারা যায় আন্ত্রিক ও জলবাহিত রোগে। অথচ মধ্য ও উচ্চবিত্তদের সে ক্ষেত্রে অসুবিধাটা কম, কারণ তারা তো আগেই আয়নিক পদ্ধতিতে জল পরিশোধন করে নেয়। তাই নগরোন্নয়ন মন্ত্রী যখন বলেন, বর্ষার উপর ভরসা করা ছাড়া ডেঙ্গি কমানোর উপায় নেই, তখন নাগরিক সমাজকে ঢোঁক গিলে চুপ করে থাকতে হয়। তাঁরা বলতে পারেন না, দেখাও কত জন দরকার ছিল মশা মারতে, রক্ত পরীক্ষা করতে, পতঙ্গবিশেষজ্ঞের কাজ করতে, আর কত জন বাস্তবিক কাজ করছেন। দেখাও কত বরাদ্দ ছিল, কত খরচ হয়েছে, কী ফল হয়েছে সে খরচের। সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিকল্পনায় সুসংহতির অভাব, নাগরিক সমাজের জনবিচ্ছিন্নতা, আর রাজনৈতিক দলের সংকীর্ণ দৃষ্টি, এগুলোর সংযোগে কী মারাত্মক ফল ফলতে পারে, এ বারের ডেঙ্গি তার আভাস দিয়ে গেল।
|
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|