আমাদের ছেলেবেলায় উঁচু কোনও বাড়ি ছিল না। প্রাক্তন জমিদার, অভিজাত শ্রেণি আর ধনী ব্যবসায়ীদের অনেকখানি ছড়ানো বাগানওয়ালা বাড়ি ছিল। কলকাতার প্রান্তসীমার ও পাশে আর এক ধনিক শ্রেণির প্রমোদ ভবন। তার পর এক সময় শুরু হল জমি নিয়ে টানাটানি। তখন আর ছড়ানো বাড়ির বদলে নতুন বাড়িগুলো হতে লাগল ঊর্ধ্বমুখী। রিফিউজিদের ঢল নামার পর তারা ওই সব বাগানবাড়ি দখল করে নিল। বাগানবাড়ি দখল করা খুব বেশি শক্ত কিছু নয়, কিন্তু ফ্ল্যাট বাড়ি সে ভাবে দখল করা যায় না। শুরু হয়ে গেল ফ্ল্যাট কালচার।
আমি থাকতাম তখন উত্তর কলকাতায়। হাতিবাগান অঞ্চলে অনেকগুলি থিয়েটার হল ছিল এবং ছিল একটি বেশ সুসজ্জিত সিনেমা হল, রূপবাণী। বাংলা উচ্চারণের নিয়ম অনুযায়ী বলা উচিত রুপোবাণী। অনেকেই অবশ্য বলত, রূপ্বাণী। তার পাশেই গড়ে উঠল একটা পাঁচতলা বিশাল ফ্ল্যাটবাড়ি। সেটা এমনই অভিনব যে অজ পাড়াগাঁ থেকেও অনেক ছেলেমেয়ে সেটা দেখতে আসত। সেটার নাম হয়ে গেল পাঁচ তলা বাড়ি, এবং দিক্দর্শক। ওই অঞ্চলের কোনও ঠিকানা বলতে হলে বলা হত, ওই তো পাঁচ তলা বাড়ির ডান দিকে বা পিছন দিকে ইত্যাদি।
এখন তো পৃথিবীর অনেক শহরের মতন কলকাতায়ও কুড়ি-তিরিশ তলা অট্টালিকায় ভরে গেছে। আমি নিজেও এখন একটা উঁচু বাড়িতে থাকি। এই ফ্ল্যাটবাড়ির উপকারিতা-অপকারিতা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয়। তার মধ্যে একটা সর্বসম্মত তথ্য উঠে আসে। আত্মহত্যা করার জন্য এই উঁচুবাড়ির অবস্থান বেশ সুবিধাজনক।
খবররে কাগজে প্রায় রোজই খুন বা আত্মহত্যা, ধর্ষণ বা শ্লীলতাহানির খবর পড়তে পড়তে গা গুলিয়ে ওঠে। তাই ইদানীং আর ও-সব একেবারেই পড়ি না। কয়েক দিন আগে এক জন পরিচিত মানুষ ফোন করে বলল, দাদা, আপনি খবরটা দেখেছেন? মুকুতা আর নেই। সে তার মা আর এক বোনকে নিয়ে...।
জীবনে এমন কিছু ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়। যা কিছুতেই বিশ্বাস করা যায় না। আমার সমস্ত পরিচিত ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন, সবারই একটা চরিত্র-চিত্র তৈরি করে নিই নিজের বিচারক্রমে। অর্থাৎ আমাদের বোধের মধ্যে রয়েছে একটা বিরাট আর্ট গ্যালারি। যাতে রয়েছে সব চেনা মানুষের ছবি আর তাদের সম্পর্কে আমার ধারণা-বর্ণনা। সেই সব চরিত্র-চিত্রণ বাস্তবে কিছুটা এ-দিক ও-দিক হতেই পারে। কিন্তু সম্পূর্ণ ভাবে বিপরীত হলে মেনে নিতে কষ্ট হয়। যেমন ধরা যাক, এক জন খুব ভাল তবলা বাজায়। হঠাৎ যদি সে ছবি এঁকে খুব নাম করে ফেলে, তাতে অস্বাভাবিক কিছু নেই, আমরা মেনে নিই, খুশি হই। কিন্তু এমন এক জন বন্ধু প্রায়ই আসে আমাদের বাড়ি। মুড়ি আর বেগুনি খেয়ে আড্ডা দেয় আমাদের সঙ্গে। আমার স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। তার পর যদি এক দিন হঠাৎ দেখি যে, রাস্তায় আমাকে দেখেও মুখ ফিরিয়ে থাকে, ডাকলেও সাড়া দেয় না। তাতে কেমন লাগে? কারণটা খোঁজার জন্য আমার রাত্তিরে ঘুম চলে যায়। |
সেই রকমই মুকুতা সম্পর্কে আমরা যে ধারণা করে রেখেছি, তাতে এই সরল তেজি মেয়েটি যদি দেখে কোনও ব্যক্তি তার আদর্শকে বাধা দিচ্ছে কুৎসিত ব্যবহার করে, তা হলে ঝোঁকের মাথায় মুকুতা তাকে গুলি করে মেরে ফেলতেও পারে। তা আমি বিশ্বাস করে নিতে পারি। কিন্তু আত্মহত্যা? এ তো তার চরিত্র থেকে একেবারে বিপরীত মেরুতে সরে যাওয়া।
কত দিন ধরে চিনি মুকুতাকে। সে নিজে নিজেই দেখা করতে এসেছিল আমাদের বাড়িতে। তখন সে বেহালা ফ্লাইট ক্লাবে বিমান-উড়ান শিখছে। যত দূর জানি, দশ হাজার মাইল নিজে নিজে চালাতে শিখলে তবেই সে পাইলট হওয়ার পরীক্ষায় যোগ্য হতে পারে। সংখ্যাটা ঠিক না-ও হতে পারে। মুকুতার সাড়ে সাত হাজার মাইল হয়েছে তখন পর্যন্ত। এই শেষের দিকটায় খরচও বেশি। যাই হোক, সে সব ব্যবস্থা হয়ে গেল, পরে মুকুতা পাইলট হওয়ার লাইসেন্স পেয়েছে। মেয়েদের পক্ষে পাইলট হওয়া এখন আর অভিনব কিছু নয়। অনেক আগেই দুর্বা ব্যানার্জির নাম শুনেছি। কিন্তু আমাদের চেনাশোনা, মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি মেয়ে হঠাৎ আকাশে উড়তে চাইবে কেন, তা নিয়ে আমাদের কৌতূহল থাকবেই। পাইলট হয়েও মুকুতা কিন্তু সেটাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেনি। কেন, তা জানি না। তার বাবা এক জন সরকারি অফিসার, মুকুতা মাঝে মাঝে ছোটখাটো কাজ করে কিছু উপার্জন করত, সে বাঁধা পড়ে থাকতে চায়নি। এবং মধ্যবিত্ত জীবনের ধারা অনুযায়ী এই সময়েই তো বিয়ে হয়ে যাওয়ার কথা। সে বেশ সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং আকর্ষণীয়া তরুণী। তবু তার বিয়ে বিষয়ে কোনও প্রস্তাবনার কথাও শুনিনি। তার সঙ্গে কোনও পুরুষের গোপন হৃদয়-সম্পর্ক ছিল কি না তাও জানা যায়নি। মাঝে মাঝে হঠাৎ সে চলে আসত এক ঝলক স্নিগ্ধ, মিষ্টি বাতাসের মতন। এর মধ্যেই সে হয়ে উঠল এক জন সমাজকর্মী এবং কট্টর ভাবে পরিবেশ সংরক্ষণের সৈনিক। কোথাও বেআইনি গাছ কাটা কিংবা পুকুর ভরাটের খবর পেলেই সে ছুটে যেত সেখানে। কখনও দলবদ্ধ ভাবে, কখনও একাই সে সব জায়গায় প্রতিরোধ গড়ে তুলত। সেই জন্যই প্রোমোটার নামের যে শ্রেণির এখন খুব রমরমা, তাদের একটা অংশ দু’চক্ষে দেখতে পারত না। টাকার লোভ দেখিয়ে কিংবা হত্যার হুমকি দিয়েও তাকে বাধ্য করা যেত না। তারা ভাড়াটে খুনি লাগিয়ে তাকে মেরে ফেলতেও পারত। মুকুতার মতো মেয়েকে মেরে ফেলা যায়, কিন্তু জয় করা যায় না।
আমাদের পরিবারে স্বাতীর সঙ্গেই তার পরিচয় ছিল বেশি। সেই স্বাতীকেও সে একবার বকুনি দিয়েছিল। ব্যাপারটা হয়েছিল কী, আমাদের শান্তিনিকেতনের বাড়ির পাশেই আছে একটা ছোট পুকুর। এটা আমার পূর্ববঙ্গীয় স্মৃতি আর শখের ব্যাপার। আমি সেখানে ছিপ ফেলে বসে থাকতাম অনেকক্ষণ। তার মধ্যে কয়েক বার মাছও ধরেছি। কয়েকটা হাঁসও সেখানে খেলে বেড়ায়। দেখেছি মাছ-ধরা পাখির সুনিপুণ ছোঁ মারা। দু-একটা সাপেরও ডুব সাঁতার।
একবার আমি দেশের বাইরে ছিলাম কিছু দিন, তারই মধ্যে স্বাতী কিছু লোকের ভুল পরামর্শে পুকুরটার চার পাশ সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেয়। কিছু কিছু ক্লাবের সুইমিং পুল থাকে এ রকম। কিন্তু তাদের ব্যবস্থা অন্য রকম। গাঁয়ে-গঞ্জে সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য পুকুরে এ রকম ভাবে বাঁধানোর রীতি নেই। কারণ, বৃষ্টির সময় পাড়ের মাটি ধুয়ে ধুয়ে যে জলের ধারা পুকুরের জলে মেশে, তার মধ্যেই থাকে মাছ ও অন্যান্য পোকা-মাকড়ের কিছুটা খাদ্য। সিমেন্টের ওপর দিয়ে জল গড়িয়ে এলে তাতে কিছুই থাকে না। এটা এক ধরনের পরিবেশ দূষণও বটে।
মুকুতা এক দিন এসে আমাদের পুকুরের সেই দশা দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। তার পর বলতে লাগল, ছি ছি ছি, বউদি, তুমি এই কাজ করলে? আমি অনেক জায়গায় পুকুর বাঁধানোর কাজ আটকাবার জন্য ধর্না দিই, আর তুমি আমার প্রিয় বউদি এ কাজ করলে?
মুকুতার এই ধরনের আহত ছটফটানি দেখে স্বাতী বলল, আমি ভুল করেছি রে। ঠিক বুঝতে পারিনি। এখন বুঝেছি, ওই পুকুর ধারের সিমেন্ট আমি সব ভেঙে দেব।
আমিও তাতে যোগ দিয়ে বললাম, মুকুতা শান্ত হও। আমরা আজ কালের মধ্যেই ওটা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করছি।
পরে খবর নিয়ে জানলাম, পুকুর পাড় সিমেন্ট দিয়ে বাঁধিয়ে দেওয়া সহজ, ভেঙে ফেলা তার থেকে অনেক শক্ত। খরচও অনেক বেশি। ভাঙা সিমেন্টের চাঁই জমে গেলে তা আবার ওঠানো খুবই কষ্টসাধ্য।
মুকুতাকে আমরা কথা দিয়েছিলাম। সে কথা রাখতে পারিনি এখনও। মুকুতা আমাদের আর একটু সময় দিল না। আগেই বলেছি, মুকুতা কারওকে খুন করে ফেললেও ততটা অবাক হতাম না। কিন্তু আত্মহত্যা! আমার সমস্ত অভিজ্ঞতার বাইরে। মুকুতার পক্ষে এমন আত্মহত্যা একেবারেই মানায় না। কোনও আত্মহত্যার খবর শুনলে অনেক মানুষ তার একটা কার্য-কারণ খোঁজার চেষ্টা করে। নিজেরা কিছু তত্ত্বও বানিয়ে ফেলে। মুকুতার এই ব্যাপার সম্পর্কে নিজস্ব কোনও তত্ত্ব বলতে আমি অক্ষম। আর এক পরিবারের কয়েক জন মিলে আত্মহত্যা আমার পক্ষে সম্পূর্ণ দুর্বোধ্য ব্যাপার। মুকুতা এই কাণ্ডটি করার আগে যদি ঘুণাক্ষরেও কিছু ইঙ্গিত দিত, তা হলে তাকে বকেঝকে হয়তো নিবৃত্ত করতেও পারতাম। মুকুতা সে সুযোগ আমাদের দিল না। |