রাত নামলেই দুষ্কৃতীদের দখলে পিয়ালা |
নিজস্ব সংবাদদাতা • দুর্গাপুর |
জাতীয় সড়কের এক পাশে কালীমন্দির, অন্য পাশে শ্মশান।
নামেই দুর্গাপুরের ঝাঁ চকচকে সিটি সেন্টার। বেশ কিছু জঙ্গল পেরিয়ে পিয়ালা কালীমন্দির। পাশে পিয়ালা গ্রাম। একেবারে জাতীয় সড়কের গায়ে। কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই এলাকা সুনসান।
কালীবাড়িতে আলো জ্বলে। আর ভরসা গাড়ির হেডলাইট। রবিবার গভীর রাতে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে রাজ্যের নজর গিয়ে পড়েছে সেখানে। আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দ জানিয়েছেন, ওই এলাকায় পুলিশ তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু সিটি সেন্টার পুলিশ ফাঁড়ি থেকে মোটে কিলোমিটার খানেক দূর হওয়া সত্ত্বেও সেখানে যে সমাজবিরোধীদের আনাগোনা চলে, তা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সন্ধ্যা নামলেই মদ-গাঁজার ঠেক থেকে নানাবিধ দুষ্কর্মের আখড়ায় পরিণত হয় পিয়ালা কালীবাড়ি সংলগ্ন এলাকা। অপরাধীরা জড়ো হয়ে নানা দুষ্কর্মের পরিকল্পনা করে। কাছেই রাজ্য সরকারি সংস্থা দুর্গাপুর প্রজেক্টস লিমিটেড (ডিপিএল)। ইদানীং সেখানে বেসরকারি নিরাপত্তারক্ষীরা কাজ করছেন না। এই শিথিলতার সুযোগে আশপাশে লোহাচোরেরা জড়ো হচ্ছে। দিন কয়েক আগে দিনের বেলাতেই পিয়ালা শ্মশান লাগোয়া এলাকা দিয়ে ঢুকে তারা ডিপিএলের লোহার যন্ত্রাংশ চুরি করতে শুরু করেছিল। খবর পেয়ে কোকওভেন থানার পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
রবিবার রাতে গণধর্ষণের ঘটনায় এখনও পর্যন্ত পিয়ালা গ্রামেরই দশ জনকে ধরেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে এক জনের বিরুদ্ধে আগে লোহাচুরির অভিযোগ থাকলেও বাকিদের বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের ‘রেকর্ড’ নেই। দশম শ্রেণির এক পড়ুয়াকেও পুলিশ ধরেছে। গ্রামবাসীদের একাংশের বক্তব্য, “আসল অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পুলিশ তাদের ধরতে পারছে না।” দশম শ্রেণিতে পড়া যে কিশোরকে পুলিশ ধরেছে, তার দিদিমা নাতির দোষ মানতে চাননি। অন্য অনেকেই দাবি করেছেন, বিনা দোষে তাদের বাড়ির লোককে পুলিশ ধরেছে। সাহনী ওরাং নামে এক মহিলা জানান, তাঁর ছেলের বয়স ১৯ বছর। বছর দুয়েক ছাপাখানায় কাজ করছে। স্বামী নেই, ছেলের আয়েই সংসার চলে। ছোট ছেলে অম্বিক পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। এবার কী ভাবে দিন চলবে, তা তিনি ভেবে পাচ্ছেন না। তাঁর দাবি, “আমার ছেলে নির্দোষ। পুলিশ কোথাও একটা ভুল করছে।”
কিন্তু অপরাধীদের বাড়বাড়ন্তে এলাকার বহু বাসিন্দাই যে চিন্তিত, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। একটাই বাঁচোয়া, দুষ্কৃতীরা সাধারণত স্থানীয় বাসিন্দাদের বিরক্ত করে না। তাই তাঁরাও এ সব নিয়ে তেমন হইচই করেন না। কিন্তু ইদানীং রাতে পিয়ালা কালীবাড়ি সংলগ্ন এলাকা যে ভাবে অপরাধীদের খাসতালুক হয়ে উঠছে, তাতে অনেকেই শঙ্কিত। গ্রামবাসীর অভিযোগ, রাত বাড়লে জাতীয় সড়কে পুলিশের টহলদার জিপেরও দেখা মেলে না। রবিবার রাতে বেশ কিছু ক্ষণ ধরে দেখা গণধর্ষণ চললেও যেমন তাদের দেখা মেলেনি। আর সেই সুযোগেই অপরাধীরা জড়ো হয়।
পুলিশের খাতাই বলছে, অতীতে এই এলাকা থেকেই বেশ কয়েক বার বিএসএনএলের চুরি যাওয়া তামার কেব্ল উদ্ধার হয়েছে। ধরা পড়েছে একাধিক দুষ্কৃতী। অথচ তার পরেও রাতে পুলিশি প্রহরার কোনও ব্যবস্থা হয়নি বলে অভিযোগ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গ্রামবাসী বলেন, “রাতে জাতীয় সড়কে আমাদের যাওয়ার দরকার পড়ে না তেমন। কিন্তু কোনও কারণে যেতে হলে গা ছমছম করে!” সিটি সেন্টারের উদয়শঙ্কর বিথীর বাসিন্দা আনন্দ মণ্ডলের মতে, “জাতীয় সড়ক ধরে যাতায়াতে কোনও ভয় নেই। কিন্তু পিয়ালা কালীবাড়ি এলাকায় থামা মানেই বিপদ ডেকে আনা!” তাঁর মতো অনেকেরই মতে, রবিবার গভীর রাতে তরুণী এবং তাঁর স্বামী ঠিক সেই ভুলই করেছিলেন।
পরিস্থিতি যে এতটা ভয়াবহ, তা অবশ্য পুলিশ মানতে চায়নি। তাদের দাবি, জাতীয় সড়কে টহলদার জিপের যাতায়াত লেগেই থাকে। তবে দু’টি জিপের আসা-যাওয়ার মধ্যে সময়ের কিছুটা ফারাক রয়ে যায়। রবিবার রাতে সেই সময়টুকুর মধ্যেই গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। তাই পুলিশ টের পায়নি। পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দের দাবি, “গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত ধরে ফেলা গিয়েছে। অন্য দুষ্কৃতীরা অপরাধ করার আগে ভাববে।”
ধর্ষণের পরে ধরপাকড়ের চেয়ে অপরাধের পরিস্থিতি তৈরি হতে না দেওয়াটাই যে বেশি জরুরি, তা সম্ভবত পুলিশের জানা।
|