নির্বাচকদের ‘একদল ভাঁড়’ বলে ক্রিকেটজীবনে এক রকম নির্বাসিত হয়ে গিয়েছিলেন।
আর নির্বাচক থাকা অবস্থায় বোর্ড প্রধানের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে ফের নির্বাসিত হতে যাচ্ছেন।
ক্রিকেটার থেকে নির্বাচক—দু’বারই অপ্রিয় কথা বলে প্রশাসনের কোপে পড়ার একটা বৃত্তই যেন সম্পূর্ণ করে ফেলছেন মোহিন্দর অমরনাথ। ’৮৮-র নভেম্বরে নির্বাচকদের বিরুদ্ধে সেই বিবৃতির পর তাঁর ক্রিকেটজীবন কার্যত পেনশনের খাতায় চলে যায়। আর নির্বাচক হিসেবে চূড়ান্ত ভাগ্য জানা যাবে আর হপ্তা তিনেকের মধ্যে। এই মুম্বইতেই। বোর্ডের বার্ষিক সাধারণ সভা যে দিন নতুন মরসুমের জন্য নতুন জাতীয় নির্বাচক কমিটি তৈরি করবে।
ক্রিকেটার মোহিন্দরের কী ‘অপরাধ’ ছিল সবাই জানেন। ঢাকায় এশিয়া কাপ ফাইনালে ম্যাচ জেতানো ইনিংসের পরেও রাজ সিংহের কমিটি তাঁকে বাদ দেওয়ায় উত্তেজিত প্রতিবাদ করেছিলেন। গোটা ক্রিকেটবিশ্ব জানত, মোহিন্দরের প্রতিবাদ ন্যায্য। হ্যাডলির টিমের বিরুদ্ধে অবশ্যই তাঁকে টেস্টে নেওয়া উচিত ছিল। তবু মুখ খোলার অপরাধে তাঁকে ক্রিকেটজীবনের প্রান্তিক স্টেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ভারতের হয়ে আর এক-আধ বার যা খেলেন, না খেলার মতোই।
চব্বিশ বছর পর আবার তিনি তরোয়ালের সামনে। অনেকের মতে, সেই ন্যায্য প্রতিবাদ করেই। বোর্ড শীর্ষকর্তা তাঁর ওপর চটেছেন যেহেতু ভারত অধিনায়কত্ব থেকে তিনি মহেন্দ্র সিংহ ধোনিকে সরাতে চেয়েছিলেন। মুম্বইয়ে হওয়া শেষ নির্বাচনী বৈঠকে মোহিন্দর পরিষ্কার বলেন, টানা আটটা টেস্ট ম্যাচ হেরে আসা ক্যাপ্টেনকে সরানো উচিত। ক্যাপ্টেন করা হোক গৌতম গম্ভীরকে। নির্বাচক প্রধান শ্রীকান্ত হঠাৎ করে জিমি অমরনাথের এই মন্তব্যে হকচকিয়ে যান। মোহিন্দর আবার সঙ্গে পেয়ে যান আরও দুই নির্বাচককে। সাধারণ পরিস্থিতিতে ৩-২ হয়ে গম্ভীরেরই অধিনায়ক হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই সময় দৈববাণীর মতো নির্বাচকদের জানিয়ে দেওয়া হয়, বোর্ড ধোনিকে নেতৃত্ব থেকে সরাতে চায় না। মোহিন্দর এরপর অশ্বিনের বিরুদ্ধে হরভজনের হয়েও সওয়াল করেন। এটাও চেন্নাই সুপার কিংস তথা বোর্ড প্রধানের পছন্দসই বক্তব্য নয়। এর পরে হরভজন টি-টোয়েন্টি দলে ঢোকেন বটে, কিন্তু তিক্ততার রেশটা থেকেই যায়। গত এক বছর কমিটিতে ঢুকেছেন মোহিন্দর। অনেক কিছুতেই তিনি ‘জো হুজুর’ হননি। কর্তারা এমনিতেই বিরক্ত ছিলেন। কিন্তু ধোনিকে সরাতে চাওয়া তাঁদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিয়েছে।
শনিবার মুম্বই ক্রিকেটমহলে শোনা গেল, মোহিন্দরকে হয়তো রাখা হবে না। যুক্তি হল, উত্তরাঞ্চল নির্বাচক হয়েও তিনি থাকেন গোয়াতে। তা হলে তিনি উত্তরাঞ্চলের ছেলেদের খেলা কী ভাবে দেখবেন? এখন পর্যন্ত যা পরিস্থিতি, উত্তর যার নামই সুপারিশ করুক, মোহিন্দরের করবে না। দক্ষিণাঞ্চল থেকে নির্বাচক কমিটিতে আসবেন রজার বিনি। তাঁকে চেয়ারম্যান করে দেওয়া হবে। এমনিতে মোহিন্দরের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা। কিন্তু কর্তারা প্রমাদ গুনছেন, এই লোক যদি চেয়ারম্যান হয় তা হলে আরও অজানা বিপদ তাঁদের জন্য অপেক্ষা করে থাকতে পারে। প্রশ্ন উঠেছে, মোহিন্দর গত বছরও গোয়াতেই থাকতেন। তখন জেনেশুনেই তো উত্তরাঞ্চল কর্তারা তাঁর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। তা হলে এ বার পিছিয়ে যাচ্ছেন কেন? এ দিন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রাক্তন জাতীয় ক্রিকেটার বললেন, “জিমিকে তো পশ্চিমাঞ্চল থেকেও আনা যায়। পশ্চিম থেকে এ বার তো কোনও হেভিওয়েট ক্যান্ডিডেট নেই। আবে কুরুভিল্লার কথা ভাবা হচ্ছে। তার চেয়ে তো জিমি অনেক ভাল হবে।” কিন্তু কেউ শুনতেই চাইছে না।
মোহিন্দর—তিনি নিজে কি আঁচ পেয়ে গিয়েছেন তাঁকে নিয়ে যে এত বিতর্ক দানা বেঁধেছে? শনিবার যোগাযোগ করা হলে একচোট হাসলেন। তার পর আনন্দবাজারকে বললেন, “আমি কখনও কালকের কথা ভেবে জীবন চালাইনি। আজ যা সত্যি, সেটাই আমার কাছে সত্যি।” এর বেশি একটা কথাও তিনি বলতে রাজি নন।
ক্রিকেটমহল অবশ্য কর্তাদের কঠিন মনোভাবে আশ্চর্যের কিছু দেখছে না। তাঁরা জানেন শ্রীনিবাসনের নেতৃত্বে এই বোর্ড ভীষণ স্পর্শকাতর। ন্যূনতম সমালোচনাতেই তাদের ভয়ঙ্কর পাল্টা প্রতিক্রিয়া হয়। অধুনা তাদের কোপে পড়েছেন ভাষ্যকার হর্ষ ভোগলেও। হর্ষকে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম দু’টো টেস্ট ম্যাচে কমেন্ট্রি প্যানেল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্রোডাকশনের সম্পূর্ণ দায়িত্বে বিসিসিআই। বিশাখাপত্তনমে ধুয়ে যাওয়া ম্যাচ সমেত হর্ষ পেয়েছেন দু’টো টি-টোয়েন্টি। আর একটা নীরব হাড় হিম করে দেওয়া বার্তাও—আর বেচাল দেখলে এটাও যাবে। হর্ষ নিজে বলছেন, তিনি কিছুই বুঝতে পারছেন না। কিন্তু কানাঘুষোয় শুনেছেন, কোনও লেখায় বোর্ডের সমালোচনা করেছিলেন বলে এই মনোভাব।
সচরাচর রক্ষণাত্মক সমালোচক হিসেবে পরিচিত হর্ষের সামান্য আক্রমণ থেকেই যদি এই মনোভাব হয়, তা হলে মোহিন্দরের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব ধেয়ে আসছে, তাতে আশ্চর্য কী? শনিবার মোহিন্দরের সঙ্গে কথা বলে মনে হল, তিনি দেওয়ালের লিখন দেখতে পাচ্ছেন। আর যদি সেটা উল্টে দিয়ে তাঁকে নির্বাচক রেখে দেওয়া হয়, মোহিন্দর নিজেই সবচেয়ে আশ্চর্য হবেন। |