খোলা মাঠে নেমে এ বার প্রত্যাবর্তনের কথাও
ভাবছেন আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত সচিন
ভাইজ্যাগ স্টেডিয়ামে যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রত্যাবর্তনসূচক ল্যাপ অফ অনার দিচ্ছিলেন যুবরাজ সিংহ। তখন তিনি জানেনও না, তাঁর যেমন প্রত্যাবর্তনটা হয়েও অঘোষিত থাকল। তেমনই আবার তাঁর ক্রিকেটীয় আদর্শের সরকারি প্রত্যাবর্তনের কোনও ইস্যু না থাকলেও যেন আগমনটা থমকে রয়েছে। খাতায় কলমে যুবরাজ সিংহের কামব্যাক ঘটেনি। অথচ সেটা ক’দিন পরে চেন্নাইতে প্রায় নিশ্চিত। আর তাঁরসচিন তেন্ডুলকরের কামব্যাকের প্রশ্নই নেই। তিনি তো দলেই ছিলেন।
অথচ মুম্বই ক্রিকেটনগরীতে গত আটচল্লিশ ঘণ্টা টহলদারি করে মনে হল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তাঁর তেইশতম বছরে সচিন তেন্ডুলকর এ বার চূড়ান্ত কামব্যাকের মোড়ে দাঁড়িয়ে।
দলে আছেন অথচ মননে নেই। এ ভাবেও যে আমচি মুম্বই ক্রিকেট সমাজের একাংশ তাঁকে ভাবতে পারে এটা বোধহয় তেন্ডুলকরের জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন।
তেন্ডুলকরের আর খেলা চালিয়ে যাওয়া উচিত কি উচিত নয়এই প্রশ্নে জাতীয় মিডিয়া জগৎ এবং মুম্বই যে এ ভাবে ভাগ হয়ে যাবে, কে জানত?
এমনিতে শনিবার অনেকেরই ধারণা ছিল মুম্বই দুটো ব্যাপার নিয়ে মেতে থাকবে। টিভিতে যুবরাজের প্রত্যাবর্তন। আর আশা ভোঁসলের ৮০তম জন্মদিন পালন। আদপে দেখা গেল এই দুটোকেই পেছনে ফেলে দিয়ে এক নম্বরে উঠে এসেছে অন্য প্রশ্ন। টু বি অর নট টু বি। সচিনের আর খেলা উচিত কি উচিত না? কে বলবে মাত্র পাঁচ মাস আগে এই মুম্বই তাঁকে নিয়ে উচ্ছ্বাসের একটা বড় ঢেউ থেকে আর একটা বড় ঢেউতে লোফালুফি করেছে? শততম সেঞ্চুরির পর মুম্বই বিমানবন্দরের কাছে পাঁচতারা হোটেলে সংবর্ধনা নিয়েছিলেন সচিন। সেখানকার আবেগ দেখে কেউ ভাবতেই পারেনি নতুন মরসুমের শুরুতে এত বড় মাইন তার জন্য পোঁতা থাকবে।
শনিবার দেখা গেল জাতীয় তর্ক না হোক, এই মুহূর্তে মুম্বইয়ের রাজ্য তর্ক তো বটেই। এফএম চ্যানেল থেকে টিভি, খবরের কাগজ, লোকাল ট্রেনসর্বত্র সচিন নিয়ে জিজ্ঞাসা। রাতে মুম্বই ছেড়ে মহারাষ্ট্রের শৈল শহরের দিকে রওনা হওয়ার আগে বিরক্ত অজিত ওয়াড়েকর বললেন, “হচ্ছেটা কী? লোকে কী চাইছে বুঝে উঠতে পারছি না। কাল সৌরভ যা বলেছে আমি সম্পূর্ণ একমত। এত বড় লেজেন্ডকে বেছে নিতে দাও সে কী চাইছে।” দিলীপ বেঙ্গসরকর বললেন, “বোল্ড কি জীবনে এর আগে কেউ হয়নি? এই হঠাৎ করে তুলে দেওয়া বিতর্কটার মানে কী? আমি পৃথিবীতে এক জন ব্যাটসম্যানকেও দেখিনি যে বোল্ড হচ্ছে অথচ তাকে দেখতে দারুণ স্মার্ট লাগছে। সচিনের ফর্মে ফেরা নিছক সময়ের অপেক্ষা।” বৃদ্ধ বাপু নাদকার্নি এখন সোজা হয়ে হাঁটতে পারেন না। অর্ধেক বেঁকে গিয়েছেন। কিন্তু তিনিও সমালোচনায় ক্ষতবিক্ষত সচিনের পাশে। বলছেন, “টিভি ভাষ্যকাররা কে কী বলছে সেটা তারা বুঝবে। টিভি বুঝবে। আমি যেটুকু বুঝি, রানে ফেরাটা স্রেফ কয়েকটা মাসের ব্যাপার। তার পর সব হইচই বন্ধ হয়ে যাবে।”
ক্রিকেটসমাজের এহেন অংশ যতই সচিনের পক্ষে জোরালো ভাবে দাঁড়িয়ে যাক, সচিন-ঘনিষ্ঠরাও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন গাওস্কর যে আন্তর্জাতিক জিজ্ঞাসা তুলে দিয়েছেন তার পালেও প্রচুর বাতাস আছে। এমনকী জনমতের একটা অংশ প্রভাবিত হতে শুরু করেছে যে, তুমি অনেক দিয়েছ ঠিকই। আমরা ঋণী। কিন্তু ঊনচল্লিশ বছর বয়স হয়েছে, সেটা তোমারও ভাবা উচিত। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ ক্রিকেটার মাধব মন্ত্রী যেমন মনে করেন সচিনের দাঁড়ি টানার সময় হয়েছে। একানব্বই বছর বয়সি মন্ত্রী গাওস্করের মামা। কিন্তু সম্পর্কের খাতিরে নয়, সচিনকে ভালবেসে তাঁর ভালর জন্যই এ কথা বলতে চান। তেন্ডুলকরের প্রথম ইংল্যান্ড সফরে ম্যানেজার ছিলেন মন্ত্রী। এ দিন আনন্দবাজারকে তিনি বলছিলেন, “ম্যাঞ্চেস্টারে ওর সেঞ্চুরিটা আজও ভুলতে পারি না। আরও ভুলতে পারি না ওর বিনম্র ভাবটা। সেঞ্চুরির পরের দিন সকালে আমাকে ফোন করে বলল, স্যর একটু লবিতে আসবেন? একটা কথা বলার ছিল। আমি নীচে নামার পর বলল, আমার ইনিংসে কী ত্রুটি ছিল একটু বুঝিয়ে বলবেন? আমি তখন অভিভূত হয়ে ওকে বলেছিলাম, ত্রুটি কী বলছ ভাই? তুমি যা খেলেছ অনেক মহান ক্রিকেটার এ রকম খেলতে পারলে গর্বিত হত।” মন্ত্রী তাঁর দেখা সেরাদের তালিকায় গাওস্কর-সচিনকে সবার আগে রাখতে চান। কিন্তু এর পরেও তাঁর বক্তব্য, সচিন যেন জ্যাক হবসের মডেল অনুসরণ করেন। “হবস যে বার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট থেকে অবসর নেবেন বলে ঘোষণা করেন সেই কাউন্টি মরসুমে উনি ১৭টা সেঞ্চুরি করেছিলেন। তার পরেও তিনি অবসর নেবেন শুনে সবাই বিস্মিত হয়ে বলেছিল, ১৭টা সেঞ্চুরি করে অবসর নেবেন? হবস বলেছিলেন, তোমরা খেয়াল করোনি আগে সেঞ্চুরিগুলো করতে আমার তিন ঘণ্টা লাগত। এখন চার ঘণ্টা করে নিচ্ছি। তাই সরে যাওয়াই উচিত।” মন্ত্রী বললেন, “তেন্ডুলকরকে কার্যত পুজো করে বিশ্বের তরুণ ক্রিকেটীয় সম্প্রদায়। ওকে ভাবতে হবে এ ভাবে বোল্ড হওয়াটা তাদের মনে কতটা ধাক্কা দিচ্ছে। ভাবতে হবে, এদের মনে আমি চিরন্তন ব্যাটিং বিগ্রহ হয়ে থাকব? না কি নিছক ক’টা রানের জন্য আঁকড়ে পড়ে থাকব?”
এমন পরিস্থিতি যে, মুম্বইয়ের ক্লাব ক্রিকেটাররা অবধি সচিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনামত্ত। সম্প্রতি ইয়ান চ্যাপেল এবং মার্টিন ক্রো-র ওয়েবসাইটের দুটো লেখা উদ্ধৃত করে কেউ কেউ বলছেন, সত্যিই তো গত তেরো মাসে ১১ টেস্টে সচিনের গড় ৩৭.০৪। গত ২৪ টেস্ট ইনিংসে কোনও সেঞ্চুরি নেই। তেন্ডুলকরের টেস্ট জীবনে কখনও সেঞ্চুরির এমন খরা আসেনি। প্রতি চার টেস্টপিছু একটা শতরান পেয়েছে। এটা থেকেই বোঝা যাচ্ছে বয়সোচিত কারণে ঘটছে। কেউ কেউ আরও এক কাঠি এগিয়ে বলছে, কাগজ যা লিখছে সেটাই ঠিক। স্রেফ এন্ডোর্সমেন্টের জন্য খেলছে। মুম্বই মিডিয়ামহল মাত্র ক’মাস আগেও তাঁর এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউয়ের জন্য যে কোনও কিছু করতে প্রস্তুত ছিল। এখন সেই সার্কিটেও গুঞ্জন, দ্রাবিড়-লক্ষ্মণের রাস্তাই বোধহয় তেন্ডুলকরের অনুসরণ করা উচিত। সচিন গভীর অসম্মানিত ও অপমানিত বোধ করেছেন যখন দেখেছেন মিডিয়া এমনও লিখছে যে, তাঁকে একমাত্র বাঁচাতে পারেন আমদাবাদের পিচ প্রস্তুতকারক ধীরাজ পরসানা। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে প্রথম টেস্টে ব্যাটসম্যান-ভোগ্য উইকেট তৈরি করে।
ক’দিন আগে এবিপি আনন্দের সাক্ষাৎকারে সৌরভ সংশয় প্রকাশ করেছেন, এ সব সমালোচনা কি সচিনের কানে আদৌ পৌঁছবে? সংশয়টা মোটেও সত্যি প্রমাণিত হয়নি। আজকের মিডিয়া এবং ইন্টারনেট অধ্যুষিত যুগে সবই জানতে পারছেন তেন্ডুলকর। ঘনিষ্ঠদের মধ্যে কারও কারও মনে হচ্ছে, এ মুহূর্তে তাঁর মনোভাব কণ্টকবিদ্ধ সম্রাটের মতো। শততম সেঞ্চুরির মুকুট পরিধানের পর আচমকা দাউদাউ করে আশঙ্কার আগুন তাঁকে এ ভাবে ঘিরে ধরবে, স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি। বন্ধুদের সঙ্গে বিশ্লেষণে বসে তিনি যে সমাধানে এসেছেন, তার কথা সৌরভের মুখে কিন্তু আমরা আগেই শুনেছি। যথেষ্ট ম্যাচ প্র্যাক্টিস করতে হবে। টিম তেন্ডুলকর জেনে গিয়েছে, এই বয়সে আর বেছে বেছে ম্যাচ খেলা যাবে না। এই বয়সে তিন মাসের বিরতি তেন্ডুলকরের মতো প্রতিভাকেও রক্ষা করার জন্য যথেষ্ট নয়। তাঁকে নিয়মিত ম্যাচ খেলতে হবে। খেলে খেলে তৈরি থাকতে হবে। যাতে মস্তিষ্কের সঙ্কেতের সঙ্গে ব্যাট আর পা-টাও নড়ে। যেটা তাঁর জীবনে বরাবর ঘটে এসেছে।
ঊনচল্লিশ বছরের তেন্ডুলকর আজ তাই ক্রিকেটজীবনের বার্ধক্যে এসে তেরো বছরের তেন্ডুলকরে ফিরে যাচ্ছেন। যেখানে গুরু আচরেকরের শিখিয়ে দেওয়া মন্ত্রে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন। যত ম্যাচ খেলবে তত শিখবে। কৈশোরে শেখা সেই গায়ত্রী মন্ত্র বার্ধক্যে আঁকড়ে তিনি ঠিক করেছেন ১৫ নভেম্বর আমদাবাদে ইংল্যান্ডের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলবেন। খেলবেন অক্টোবরের দলীপ ট্রফিতে। যে প্রতিযোগিতায় শেষ তাঁকে কবে দেখা গেছে, ওপরে চলে যাওয়া দলীপ সিংজিও বলতে পারবেন না। বন্ধুরা কেউ কেউ তাঁকে প্রস্তাব দিয়েছেন, তেমন হলে তুমি মুম্বইয়ের স্থানীয় টুর্নামেন্ট খেলার কথাও ভাবতে পারো। স্থানীয় টুর্নামেন্ট বলতে কাঙ্গা লিগ। সেটাও এখন শেষের পথে। সেপ্টেম্বরের শেষে রয়েছে পুলিশ শিল্ড। পুলিশ শিল্ড হচ্ছে মুম্বই ক্রিকেটে আমন্ত্রণী এলিট টুর্নামেন্ট। এখানে খেলার জন্য কোনও ক্লাব রেজিস্ট্রেশনের প্রয়োজন নেই। অতীতে গাওস্কর-মঞ্জরেকররা বাদ দিয়ে বিদেশি বরেণ্য ক্রিকেটাররাও পুলিশ শিল্ড খেলেছেন।
ম্যাচ প্র্যাক্টিসে এখন সচিন এতই উৎসাহী যে, খোলা মাঠে সেই পুলিশ শিল্ড খেলার কথাও ভাবছেন। দলীপ ট্রফি শেষ কবে খেলেছেন সেটা যদি বা বোর্ডের অফিসে তল্লাশি করে পাওয়া যায়, পুলিশ শিল্ড শেষ খেলেছেন সম্ভবত জরাসন্ধের যুগে। সবচেয়ে বড় সমস্যা খোলা মাঠে তাঁর নিরাপত্তা। তেন্ডুলকর এমনই চুম্বক, যেখানে যান মুহূর্তে ভিড় হয়ে যায়। এমনকী তাঁর নিজের শহরেও। তিনি পুলিশ শিল্ড খেলতে নামলে রীতিমত শোভাযাত্রা হয়ে যাবে। হামলে পড়বে সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম। তখন ম্যাচ প্র্যাক্টিস তুচ্ছ হয়ে শো-টা হয়ে দাঁড়াবে বেশি। সচিন আবার সেটাও চান না। নিরাপত্তার ঝুঁকি যদি বা নিতে পারেন, লক্ষ্যের চেয়ে যদি উপলক্ষ বড় হয়ে দাঁড়ায় সেটা কি মানবেন? শোনা গেল এই দোলাচলে তিনি নিজেও সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত।
টিম তেন্ডুলকর জানত শততম সেঞ্চুরির স্তম্ভে উঠে যাওয়ার পর এখন মাথার ওপর শুধুই বিস্তীর্ণ নীল আকাশ। কোথাও কোনও শত্রু নেই। কোথাও কোনও কালো মেঘ নেই। কোথাও কোনও হঠাৎ করে আসা বিপদ নেই। তারা জানত এই পুরো মরসুমটা খেলা শেষ করলে তেন্ডুলকরের টেস্ট-সংখ্যা দাঁড়াবে ১৯৮। এর পর ২০১৩-র শেষাশেষি দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গেলেই আরও একটা ক্রিকেটীয় এভারেস্ট তাঁর জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। একমাত্র মনুষ্য হিসেবে দুশো টেস্ট ম্যাচ খেলা। তখন কে জানত, দুশো টেস্টের দিকে এগিয়ে যাওয়ার বায়ুমণ্ডলে এমন অতর্কিত শত্রু অপেক্ষা করে থাকবে? আর তাঁকে ফেলে দেবে ক্রূর গ্রেগ চ্যাপেলের চেয়েও কঠিনতর চ্যালেঞ্জের সামনেএখনই প্রমাণ করো, নইলে বিদেয় হও।
যাঁরা ভেবেছিলেন সচিন তেন্ডুলকরের জীবন নিয়ে সিনেমা করার মতো সব শট নেওয়া হয়ে গেছে, তাঁরা জানেনও না আগামী ক’মাসের কিছু দৃশ্য ছাড়া তাঁদের পুরো ছবিটাই বেকার।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.