|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
বিপ্লব শেষ হয়নি বন্ধু |
বললেন প্রবীণ অধ্যাপক। কুড়ি বছর পরে তাঁর গলায় নতুন প্রাণ।
তাঁর দেশটাতেও। চেনা রাশিয়ায় নতুন দেশ দেখে এলেন
বিকাশ সিংহ |
সেপ্টেম্বর-অক্টোবর, ১৯৯১। কৃষ্ণসাগরের তীরে ওডেসা পৌঁছলাম। মস্কো থেকে প্লেনে দেড় ঘণ্টা। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাঁধন খুলছে গর্বাচভের পেরেস্ত্রোইকার কল্যাণে। রাশিয়ার পুরনো রূপ ফিরছে। ফিরে আসছে ইউক্রেন, তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান’রা।
মস্কো এয়ারপোর্টে নিতে এলেন এক অধ্যাপক। একেবারেই খিদে ছিল না। কিন্তু ওঁর স্ত্রী, অপূর্ব সুন্দরী, বললেন ‘স্টক্ আপ স্টক্ আপ’। মানে না বুঝে ফ্যাল ফ্যাল চেয়ে থাকলাম। দেখে উনি বললেন, ‘আবার কখন খেতে পাবেন বলা শক্ত।’ মস্কোর অন্য একটি ছোট এয়ারপোর্টে যেতে হবে, কিন্তু কীসে যাব? গাড়ি তো নেই। রাস্তায় বাক্সপ্যাঁটরা নিয়ে দাঁড়ালাম। অধ্যাপক ভদ্রলোক আমাদের দেশের ‘উলু’ দেওয়ার মতন একটা আওয়াজ করতে থাকলেন। একটা গাড়ি থামল, ভাঙাচোরা বললে ভাল বলা হয়। আমাকে দেখে সে ড্রাইভার/মালিক বলল, ডলারে ভাড়া দিতে হবে। আমার আপত্তি ছিল না। কিন্তু আমার অধ্যাপক দৃঢ় গলায় কী একটা বললেন। যেটুকু বুঝলুম, তা মোটামুটি এই রকম: ‘রাশিয়ার মানসম্মান বলে একটা কথা আছে না!’
ওডেসা পুশকিনের দেশ। ইতিহাসের গভীর কুয়াশায় আচ্ছন্ন। পুশকিনের সঙ্গে রাজকুমারীর পরকীয়া প্রেম, কবিতার স্রোত, ওডেসার অলিগলিতে। যখন গেস্ট হাউসে পৌঁছলাম, তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নিস্তব্ধ, নিঝুম। নেহাতই উজবুকের মতন আমি অফিসের মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলাম ডাইনিং হলটা কোথায়। ভদ্রমহিলা একটু মুচকি হাসলেন। আমার ঘরের চাবি দিলেন। মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকে স্তম্ভিত। এমনই অবস্থা, দেখে কান্না এল।
আর একটি ঘরের নম্বর দিয়েছিলেন মহিলা। সিঁড়ি ঠেলে গেলুম উপরে। দরজায় টোকা দিতেই এক সৌম্যমূর্তি মানুষ বেরিয়ে এসেই (যেন অনেক দিনের পরিচিত) আহ্বান জানালেন ‘Ah, that must be Professor Sinha, welcome to Odessa.’ পেটে তখন ছুঁচোর কেত্তন। দেখলাম, অধ্যাপক আন্দ্রে (যিনি আমাকে আপ্যায়ন করেছিলেন) ঠিক ঠাহর করতে পেরেছিলাম। চিজ, সসেজ আর ঠান্ডা আলুভাজা। সন্ধ্যার আহার শেষ হল।
সকাল, দুপুর, রাত্রি, রোজই ওই আলু, সসেজ আর লাল বাঁধাকপির সালাড, এই বরাদ্দ। খিদের তাড়নায় সেটা কিন্তু অমৃতময়। কয়েক জন পরিচিত বন্ধুদের নিয়ে দিনের বেলায় আইসক্রিম খেতাম। এক জন ডলার দিয়ে হ্যাম কিনেছিল। আমার অসম্ভব ইচ্ছা থাকলেও ছুঁইনি। বন্ধুবর দুষ্টুমি করে ছোট্ট এক টুকরো হ্যাম নিয়ে আমার ঘরে হাজির। আমরা দেশে কত রকম ভাবে অভাবের তাড়নায় চেঁচামেচি করি, কিন্তু আমার রাশিয়ান সতীর্থরা একেবারে নো টুঁ-ফা।ঁ |
 |
পুনরুত্থান? নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধের (১৮১২) দুশো বছর পূর্তি।
বোরোডিনো, রাশিয়া ২ সেপ্টেম্বর, ২০১২। ছবি: এ এফ পি |
এক দিন আন্দ্রে প্রস্তাব দিল টাই পরে, জ্যাকেট পরে আমরা শহরে যাব। ভরা দুপুরেও রাস্তায় ইলেকট্রিক আলো। রোদের ছটায় ম্লান। কেন, প্রশ্ন করায় বুঝলাম, যাঁরা এগুলি চালান, অভাবের দায়ে অন্য কাজ করেন, দু’পয়সা রোজগার হয় যাতে। কাজেই আলো বন্ধ করার কারও সময় নেই, লোকও নেই। একটি বড় দোকানে ঢোকা হল। সব আলো জ্বলছে।
রাশিয়ানদের খুব কাছ থেকে দেখেছি, মিশেছি। মনের ইমোশন বা সেন্টিমেন্ট বাইরে প্রকাশ পায় না। এই চাপা ভাবপ্রবণতা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে কবিতা, সাহিত্য, নাটক, বলশয় ব্যালে, এমনকী মৌলিক বিজ্ঞানের প্রেরণার উৎস, কিন্তু রাশিয়ার মাটির বুকে রাশিয়া ছেড়ে বাইরে গিয়ে থাকতে আরম্ভ করলেই সৃষ্টিশক্তি কোথায় উবে যায়, প্রেরণার স্রোত কেমন যেন শুকিয়ে যায়। যেমন ধরুন নোবেল লেখক আলেকজান্ডার সলঝেনিৎসিন, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ পলিয়োকভ।
আন্দ্রের সব রকম ব্যবস্থাই করা ছিল। ওডেসা শহরের মাঝখানে একটি বাড়ির সামনে থামল। কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে একটা দরজায় তিন বার টোকা। দরজা খুলল, কালো টাই পরে এক সুপুরুষ যুবক আমাদের আপ্যায়ন করল। অপূর্ব সুন্দর পুরনো কালের একটি রেস্টুরেন্ট, কিন্তু সবই ডলারে কিনতে হবে। বেসমেন্ট-এর রেস্তোরাঁর পরিবেশ, আদবকায়দা, খাবারের আভিজাত্য জারের আমলেরই, কিন্তু সবটাই ব্ল্যাক-এ, ডলারে।
ওডেসায় সম্মেলন শেষ হল, আমরা কিয়েভ-এ এলুম, ট্রেনে করে, কামরাগুলি খুব সুন্দর, কিন্তু খাবার বলতে এক কাপ, দু’কাপ চা। ব্যস! আমার বিশেষ বন্ধু অধাপক জেনোভেভ কিয়েভ-এর হোটেলে মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা করেছিল। মেনুতে শ্যাম্পেন, কাভিয়ার আর নরম মাংস, চিরাচরিত আলু, আহা আলু আর আলু। ডলারে।
কিয়েভ থেকে মস্কো। রেড স্কোয়ারের কাছে হোয়াইট হাউস, যেখান থেকে ইয়েলতসিন, বিদ্রোহী চরমপন্থীদের কবল থেকে দেশকে রক্ষা করেছিলেন। রাস্তায় ফৌজদের ব্যবহার করা কামান, সাদা কাপড়ে রক্তমাখানো রিবন আর গুচ্ছ গুচ্ছ সাদা ফুল। রাশিয়া রক্ষা পেল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে নয়ছয়। অধ্যাপক জেনোভেভকে চোখের জল সংবরণ করতে দেখলুম। উনি ইউক্রেনের মানুষ।
দু’দিন পরেই বিমানবন্দর। এয়ার ইন্ডিয়া। আকাশে তারা, নীচে রাশিয়া, রহস্যে নিঝুম।
১৯৯৭ সালে ফিরে গেলাম। সাধারণ চাকুরেদের তখন গাড়ি হয়েছে, কিন্তু সব জিনিসের আকাশছোঁয়া দাম। বিশেষত খাবারদাবারের। হোটেলের লাউঞ্জ দেখলাম সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরা, সামনে একটি গ্লাস সবারই হাতে, বোতল বোতল ভদকা। গম্ভীর শুকনো মুখ, কারও মুখেই হাসি নেই। মস্কোর একটু বাইরে কতগুলি গবেষণাগারে যাওয়া হয়েছিল। বৈজ্ঞানিকরা বানসেন বার্নার-এ বাসী পাউরুটি গরম করে খাচ্ছে। যাদের ভাগ্য ভাল, একটা আপেল কিংবা কলা পেয়েছে। তাদের হোটেলে ডাকলুম পরের দিন। দেখি খুউব আস্তে আস্তে খাচ্ছে, কিন্তু বেশ পেট ভরেই। বুঝলাম, ‘স্টক আপ’।
রাশিয়া ছেড়ে দেশে ফেরার পথে মনে হল ভালুকের ঘুম ভাঙছে, কিন্তু ভোরের আলো তখনও ক্ষীণ।
ক’মাস আগে, ২০১২’য় আবার মস্কো। বিখ্যাত গিনসবার্গ আন্তর্জাতিক সম্মেলন। আগে বিমানবন্দর থেকে বেরোতে লাগত কম করে দেড় ঘণ্টা। এ বার লাগল আধ ঘণ্টা। বাইরে এসে নিজেকে চিমটি কাটতে হয় প্রায়। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। সাঁ সাঁ করে গাড়ি চলছে। ফুলে ফুলে ভরা। মানুষের ব্যবহার আগেকার মতন কর্কশ নয়। সিগারেট খাওয়া অনেক কমে গেছে। ভদকা পেতে গেলে দোকানে যেতে হবে। বাড়িঘরদুয়োর ঝকঝকে। হোটেলগুলো ইউরোপের যে কোনও হোটেলের থেকেও একটু উৎকৃষ্ট; চালে, ব্যবহারে একটা আভিজাত্য, যেটা একেবারেই ছিল না আগে। মাংস, মাছ, ফল, সব্জি অপর্যাপ্ত, লন্ডনের তুলনায় আধা দাম। সবচেয়ে বড় কথা, মুখে হাসি। সব জায়গায় রুবল চলে। পুরনো কালের গানের সুর পিয়ানোতে, চা চা গানের তাল, স্ট্রাউসের ওয়ালজ্! সম্মেলনে আন্দ্রের সঙ্গে আবার দেখা। তিনি এখন লেবেদেভ ইনস্টিটিউটের সিনিয়র অধ্যাপক। সেই আনন্দময় উচ্ছ্বাস আরও গভীরে পৌঁছেছে, ‘Ah, professor Sinha, you must be...’, পরনে সিল্ক টুইড। বললেন, ‘যুদ্ধে জিত হয়েছে, কিন্তু বিপ্লব শেষ হয়নি বন্ধু!’ |
|
|
 |
|
|