সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। আর, সংসার যদি বা দুঃখের হয় পুরুষের দোষে, তাহা হইলেও রমণীকে সেই দোষ হইতে দৃষ্টি সরাইয়া, নিজ সহনশীলতার গুণ দিয়া তাহাকে প্রাণপণ ঢাকিয়া, সংসারের শান্তি ও স্নিগ্ধতার সকল দায় কেবলমাত্র নিজ পেলব স্কন্ধে লইয়া, যেন তেন তরী টানিতে হইবে। নহিলে, বকুনি। কে বকিবে? গত অগস্টের ঘটনা ধরিলে, স্বয়ং মহামান্য আদালত। কর্নাটক-এর উচ্চ আদালতে একটি মামলা আসিয়াছিল, স্বামীর হাতে বারংবার প্রচণ্ড প্রহার সহিতে না পারিয়া এক মহিলা তাঁহার দুই সন্তান লইয়া বাপের বাড়িতে গিয়া উঠিয়াছিলেন। ইহাতে পুরুষ-বিচারক (দুই বিচারকের বেঞ্চ এক জন পুরুষ, এক জন মহিলা) বিস্মিত হইয়া বলেন, সকল বিবাহেই তো নারীরা অশেষ কষ্ট ভোগ করেন। আপনার স্বামী ভাল রোজগার করিয়া থাকেন, দিব্য খাওয়ান-পরান, আপনি খামখা প্রহারের কথা তুলিতেছেন কেন? জানি, কষ্ট সহ্য করিয়াছেন। কিন্তু নারীজন্মের সামগ্রিক কষ্টের তুলনায় তাহা কী এমন? এই তো (মহিলা-বিচারকের দিকে ইঙ্গিত করিয়া) ইনিও কষ্ট সহিয়াছেন। এই হিতোপদেশ শুনিয়াও মহিলার জ্ঞানোন্মেষ হয় না, নারী মাত্রেই দুঃখার্ণবে হাবুডুবু খাওয়ার ভবিতব্য স্মিতচিত্তে মানিয়া না লইয়া, তিনি মারকুটে স্বামীর ঘর করিতে অসম্মত হন। এ বার বিচারক ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করেন, মহিলাকে বলেন, স্বামীর সহিত রেস্তোরাঁয় দোসা ভক্ষণ করিয়া মিটমাট করিয়া নিন। এই বিচারক মহাশয় অধুনা ভারতবিখ্যাত, ‘লাঞ্চ খাও এবং অতীত ভুলিয়া যাও’ সমাধান সরবরাহের কারণে। বিচ্ছেদকামী দম্পতি আদালতে আসিলেই তিনি তাঁহাদের তৎক্ষণাৎ উদরপূর্তি ও নিশ্চিত ফুর্তির পথে রওয়ানা করিয়া দেন। কিন্তু জিহ্বায় জলের আগমন ও চক্ষে জলের প্রস্থানের এই সরল সমীকরণ সম্পর্কেও মহিলাকে নিরুৎসাহ দেখিয়া, বিচারক একটি আশ্চর্য প্রশ্ন করেন, তিনি বলেন, আপনার পিতাকে জিজ্ঞাসা করুন তো, তিনি কখনও আপনার মাতাকে প্রহার করেন নাই? শেষে উকিল যখন নারীটির প্রহৃত, বিকৃত মুখের ছবি দেখান, বিচারক মহিলাকে প্রশ্ন করেন, আপনি কী চান? টাকার জন্য এই সব কাণ্ড করিতেছেন?
আমাদের সমাজ পুরুষের দোষ বিশেষ দেখিতে পায় না, উপরন্তু ‘কী আশ্চর্য, যে ভাত দেয়, সে তো টানিয়া থাপ্পড় মারিবেই’ মর্মে ভার্যা-নিগ্রহের প্রতি সস্নেহ প্রশ্রয় লইয়া তাকাইয়া থাকে। সেই অনুমোদন বৃদ্ধি পাইতে পাইতে ‘ভাত না দিলেও সে যদৃচ্ছা লাথিঝ্যাঁটা ঝাড়িবে’ অবধি উপচিয়া উঠিয়াছে, দুর্গন্ধও ছাড়িতেছে। কিন্তু আদালত তো সমাজের অধিকাংশের মতামত টিয়া-বুলির ন্যায় আবৃত্তি করিতে বসিয়া নাই, সে সমগ্র রাষ্ট্রের কাঙ্ক্ষিত ও শ্রেয় মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করে, গোটা দেশের শুভবোধের প্রতিভূ হইয়া কাজ করে। পরিবার রক্ষা তাহার একটি ঈপ্সিত পার্শ্ব-কাজ হইতে পারে, কিন্তু তাহার অধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ মানবিক অধিকার রক্ষা। এমত একটি জরুরি প্রতিষ্ঠান যাহার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণের উপর নাগরিকদের ন্যায়-অন্যায়ের ধারণা নির্ভর করিয়া আছে, যাহার ঔচিত্য-বিষয়ক বিবৃতি সমগ্র দেশের ভাবী গতিপথ অনেকাংশে নির্ধারণ করে, সর্বোপরি, যাহা নিপীড়িতের শেষ ভরসাস্থল যদি তাহার প্রশ্ন পরামর্শ ও ভর্ৎসনার মাধ্যমে এমন ভাব প্রচার করে: ঘটনা ও সম্পর্ক নির্বিশেষে সকল দম্পতিই আজীবন যৌথত্বে দণ্ডিত, তাহা দুঃখবহ। কিন্তু সেই শ্রদ্ধেয় প্রতিষ্ঠান যদি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে বলে: নারীজন্ম স্বতঃই দুঃখময়, বিশেষত বিবাহিতা নারী মাত্রেই চূড়ান্ত বেদনা বহনে বলিপ্রদত্ত এবং অভিযোগ-বিহীন ভাবে সেই জোয়াল টানিয়া লইয়া না যাইলেই পত্নীটি দুরভিসন্ধিপরায়ণ, তা ছাড়া স্ত্রী-প্রহার আমাদের ঐতিহ্যের অংশ ও অবশ্যগ্রাহ্য প্রথা তাহা নিঃসন্দেহে প্রবল বিস্ময় ও হতাশার উদ্রেক করে। হতাশা সংক্রামক, তাহা কখনও সমীহকেও খর্ব করে। |