সম্পর্কের বিস্তর টানাপোড়েন পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত নতুন ভিসা চুক্তি হল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণর সফরের প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে এ দেশে বন্দি সব ভারতীয় মৎস্যজীবীকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাল ইসলামাবাদ। ২০১২-র মধ্যেই দু’দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রত্যয় জানাল উভয় দেশ। তবে কৃষ্ণর সফরের এই ‘তিন প্রাপ্তি’-ই যে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের পাকিস্তান সফরের পথ পুরোপুরি মসৃণ করে তুলল, এমনটা বলা যাচ্ছে না। কারণ বিদেশমন্ত্রীর এই সফরে অপ্রাপ্তির তালিকাটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় ভারতের কাছে।
অপ্রাপ্তি এক, দফায় দফায় পাক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেও মুম্বই সন্ত্রাসে অভিযুক্তদের দ্রুত শাস্তির প্রশ্নে তেমন কোনও আশ্বাসই পেলেন না বিদেশমন্ত্রী। অথচ বিশেষ এই ক্ষেত্রে কার্যকরী পদক্ষেপ দাবি করেই মনমোহন সম্প্রতি তেহরানে পাক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারিকে জানিয়েছেন, তাঁর সফরের ‘উপযুক্ত’ পরিবেশ তৈরির দায়িত্ব ইসলামাবাদেরই।
অপ্রাপ্তি দুই, কৃষ্ণর এই সফরে সর্বজিৎ সিংহের মুক্তির অনুরোধে আদৌ সাড়া দেয়নি পাকিস্তান। |
অপ্রাপ্তি তিন, সফর শেষের যৌথ বিবৃতিতে কাশ্মীর প্রসঙ্গ জুড়ে দিয়ে তিক্ততা সেই জিইয়েই রাখল পাকিস্তান।
এই তিনটি ক্ষেত্রেই পাক অবস্থানে নাটকীয় কোনও পরিবর্তন অবশ্য আশা করছিলেন না খোদ কৃষ্ণও। বরং বর্তমান পরিস্থিতিতে দু’দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর পক্ষে ইতিবাচক কিছু পরিবর্তন যে ঘটতে চলেছে, সে দিকেই জোর দিতে চাইছেন বিদেশমন্ত্রী। সেই অর্থে দেখলে ভারত-পাকিস্তান তথা গোটা দক্ষিণ এশিয়ার অস্থির পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের প্রতিনিধি হিসেবে আজ এক ‘সফল দৌত্য’-ই সারলেন বিদেশমন্ত্রী। দু’বছর আগে শেষ বার ইসলামাবাদ সফরে এসেছিলেন বিদেশমন্ত্রী। ভেস্তে গিয়েছিল সেই বৈঠক। সেই ‘তিক্ততার’ স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে ভারত-পাক সম্পর্ক যে এ বারে কিছুটা ‘ঘুরে দাঁড়াতে’ পারল সে কথা পাক বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খারকে পাশে নিয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়েছেন কৃষ্ণ। তাঁর কথায়, “দু’বছর আগে যখন এসেছিলাম তার তুলনায় যথেষ্ট ইতিবাচক পরিবর্তন দেখছি।”
সেই ‘ইতিবাচক’ পরিবর্তনটা ঠিক কী? বিদেশ মন্ত্রক মনে করছে, মুম্বই সন্ত্রাসের পরও দু’বছর আগে ভুটানে নতুন করে পাকিস্তানের সঙ্গে ‘সমস্ত বিষয়ে’ সামগ্রিক আলোচনা শুরু করেছিলেন মনমোহন সিংহ। এর পর থেকে যে ধারাবাহিক দৌত্য চালিয়ে গিয়েছে সরকার, তারই কূটনৈতিক ফল মিলল এত দিনে। দীর্ঘদিন কার্যত ঝুলে থাকার পর আজ দু’দেশের মধ্যে ভিসা ব্যবস্থা শিথিল করে একটি চুক্তি সই হল। যার ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও পর্যটনের মানচিত্র আমূল বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হল বলে মনে করছে দিল্লি। কৃষ্ণর সঙ্গে উষ্ণ করমর্দনের ফাঁকে পাক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রেহমান মালিকও বললেন, “এই নতুন চুক্তি বন্ধুত্বের প্রতীক।” |
ভিসা ব্যবস্থা শিথিল করায় নিয়ন্ত্রণরেখার দু’পারের মধ্যে আরও বেশি বিনিয়োগ বিনিময় ঘটবে। বাড়বে সামাজিক এবং তীর্থ-যোগাযোগও। পরের ছুটিতে মরুতীর্থ হিংলাজে ‘তীর্থ করে আসা’-র কথাও ভাবতে পারবেন ভারতের মানুষ।
ভারতের জন্য আরও উপহার নিয়ে যাচ্ছেন কৃষ্ণ। প্রথমে রেহমান মালিক, পরে পাক বিদেশমন্ত্রী হিনা রব্বানি খার আজ জানান, ‘ভারতের বিদেশমন্ত্রীর সফরের প্রতি সৌজন্য দেখিয়ে’ তাঁরা এখানকার জেলে বন্দি সমস্ত ভারতীয় মৎস্যজীবীকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “দু’দেশের মন্ত্রীই মৎস্যজীবীদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। কয়েক বছরে এঁদের অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।”
অর্থনৈতিক ভাবে ভারতকে সর্বোচ্চ সুবিধাপ্রাপ্ত দেশের মর্যাদা দেওয়ার কথা আগেই ঘোষণা করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু কবে তা রূপায়িত হবে তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা ছিল। আজ হিনা রব্বানি ঘোষণা করেছেন, “এই বছর শেষ হওয়ার আগেই আমরা ভারতকে সে ভাবেই গণ্য করব যে ভাবে অন্যান্য দেশকে দেখা হয়।” যৌথ বিবৃতিতেও বলা হয়েছে, “দু’দেশের মন্ত্রীই দৃঢ় ভাবে জানিয়েছেন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য-সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হবে। এ ব্যাপারে পথনির্দেশিকা তৈরি করার কথাও বলেছেন তাঁরা।”
গত মাসে মনমোহন তেহরানে পাক প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছিলেন, আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তিনি পাকিস্তান সফরে যেতে রাজি। তবে তার জন্য ‘উপযুক্ত পরিবেশ’ তৈরি করতে হবে পাকিস্তানকেই। ২৬/১১-র জঙ্গিদের বিচার ও ভারত-বিরোধী সন্ত্রাস রোধে বাস্তবে কিছু করে দেখাতে হবে তাদের। কৃষ্ণর সফরে ভারত-পাক ঐক্যের যে ছবিটি তৈরি হল, তাতে কি নভেম্বরে মনমোহনের ইসলামাবাদ আসার সম্ভাবনা কিছুটা উজ্জ্বল হল? স্বাভাবিক ভাবেই পাক সংবাদমাধ্যমের পক্ষ থেকে আজ এই প্রশ্ন তোলা হয়। জবাবে কৃষ্ণ বলেন, “প্রধানমন্ত্রী পাক সফর এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে যদি কোনও ধারণা তৈরি হয়, তা হলে সেটা ঠিক নয়। উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হলেই তিনি পাকিস্তান আসতে প্রস্তুত।”
পাশাপাশি বিদেশমন্ত্রী কড়া কোনও মন্তব্য না করেও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, শুধুমাত্র বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানো বা মৎস্যজীবীদের মুক্তি দেওয়াই প্রধানমন্ত্রীর পাকিস্তান সফরের জন্য যথেষ্ট নয়। তবে বিদেশমন্ত্রী এ-ও মনে করেন যে, সন্ত্রাস-রোধ ও জঙ্গিদের বিচার নিয়ে ভারতের দাবিগুলি তাঁর এই সফরে একেবারে উপেক্ষিত রয়ে গেল, এমনটাও বলা যাবে না। কারণ, তাঁর সফর শেষের যৌথ-বিবৃতিতে মুম্বই সন্ত্রাসের প্রসঙ্গটি রয়েছে।
যদিও পাকিস্তানের তরফে ওই বিবৃতিতে যোগ করা হয়েছে সমঝোতা এক্সপ্রেসে অগ্নিকাণ্ড এবং (ইতিহাসের ধারা মেনে) ‘কাশ্মীরের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা’ পূরণের প্রসঙ্গও। |