পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় • কলকাতা |
দেরাজ থেকে ‘গুপ্তধন’ বেরোল। তেত্রিশ বছর অন্তরালে থাকার পরে!
যে সময়ে সরকারি-বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ, সংক্ষেপে ‘পিপিপি’ মডেলে) মেডিক্যাল কলেজ গড়তে স্বাস্থ্য দফতর জেলায় জেলায় ফাঁকা জমি-বাড়ি খুঁজছে, ঠিক তখনই ‘নাটকীয় ভাবে’ আলিপুরদুয়ারে ৬০ একর জমির কাগজপত্র এসে পড়েছে স্বাস্থ্য-কর্তাদের হাতে। স্বাস্থ্য দফতরের মালিকানাধীন এতটা জমি যে ওখানে স্রেফ পড়ে আছে, কর্তারা তা জানতেনই না! জমির এ হেন আকালের বাজারে একে তাই ‘গুপ্তধন’ই মনে করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য-সূত্রের খবর: আলিপুরদুয়ার মহকুমার ১ নম্বর ব্লকের তপসিঘাটায় ওই বিশাল জমিটির খোঁজ মিলেছে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত সরকারি মেডিক্যাল অফিসার মানসরঞ্জন সোমের দেরাজে। গত ৩০ জুন আলিপুরদুয়ার মহকুমা হাসপাতাল থেকে মানসরঞ্জনবাবু অবসর নেন। চলে যাওয়ার আগে নিজের দেরাজ সাফ করতে গিয়ে বেশ কিছু পুরনো কাগজপত্র তাঁর হাতে আসে, যেগুলো তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালের সুপার সুজয় বিষ্ণুকে। আর সেই কাগজ থেকেই ‘গুপ্তধনের’ সন্ধান পান সুজয়বাবু। কী ভাবে?
সুজয়বাবু দেখেন, তপসিঘাটার ৬০ একরের বেশি জমির উপরে স্বাস্থ্য দফতরের মালিকানার কথা লেখা রয়েছে ওই কাগজে। জমিটা ১৯৭৯ সালে সরকারকে দান করে গিয়েছিলেন কয়েক জন। তারই নথি এত দিন দেরাজবন্দি পড়ে থাকায় ব্যাপারটা কারও নজরে আসেনি। সুজয়বাবু কালক্ষেপ না-করে সেগুলো স্বাস্থ্যভবনে পাঠিয়ে দেন। রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলেন, “মানসরঞ্জনবাবু ও সুজয়বাবুকে ধন্যবাদ। বিরাট জায়গাটা অবিলম্বে ঘিরে দিতে বলেছি। অনেক জায়গায় দখলদারেরা চাষবাস শুরু করে দিয়েছে।” |
স্বাস্থ্য দফতরের সেই জমিতে এখন চাষ-আবাদ চলছে। ছবি: নারায়ণ দে |
ঘটনাচক্রে গত সোমবারই মহাকরণে মন্ত্রিসভার সাব-কমিটির সঙ্গে স্বাস্থ্য-কর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে স্বাস্থ্য-শিক্ষায় পিপিপি মডেল চালুর সিদ্ধান্ত হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌরহিত্যে আয়োজিত বৈঠক শেষে স্বাস্থ্য-কর্তারা জানিয়েছিলেন, অন্ধ্র-কর্নাটকে ‘পিপিপি’ মডেলে ৪০-৪২টা মেডিক্যাল কলেজ গড়ে উঠেছে। অথচ এ রাজ্যে বেসরকারি উদ্যোগের মেডিক্যাল কলেজ সাকুল্যে একটি যাদবপুরের কেপিসি। স্বাস্থ্য-কর্তাদের দাবি, শুধু সরকারি মেডিক্যাল কলেজ দিয়ে ডাক্তারের ঘাটতি মেটানো অসম্ভব। তাই সরকারের জোগানো জমি-বাড়িতে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির জন্য বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি হবে।
এবং কাকতালীয় ভাবে আলিপুরদুয়ারের ‘পড়ে পাওয়া’ জমির ফাইল সোমবার বিকেলেই স্বাস্থ্যভবনে এসে পৌঁছয়। স্বাস্থ্যভবনের কর্তারা জানিয়েছেন, পিপিপি মডেলে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির জন্য গত ক’মাসে মাত্র কয়েকটি জায়গা চিহ্নিত করা গিয়েছে। যেমন কোচবিহারে জেডি হাসপাতাল, কার্শিয়াং যক্ষ্মা হাসপাতাল, ভাটপাড়া স্টেট জেনারেল ও রামপুরহাট জেলা হাসপাতাল। স্বাস্থ্য দফতর পিপিপি মডেলে অন্তত ২৫টি মেডিক্যাল কলেজ গড়তে চাইলেও জমি বড় বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে আলিপুরদুয়ারের ৬০ একরকে বড়সড় প্রাপ্তি বলেই মনে করছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা।
যাঁর দৌলতে এই প্রাপ্তি, সেই মানসরঞ্জনবাবু রাজ্যের বাইরে। টেলিফোনে তিনি বলেন, “ওই কাগজে দফতরের উপকার হয়েছে জেনে ভাল লাগছে।” আলিপুরদুয়ার হাসপাতালের সুপার সুজয়বাবু জানাচ্ছেন, “আয়ুর্বেদিক মেডিক্যাল কলেজ তৈরি আর ওষধি চাষের উদ্দেশ্যে সাত-আট জন মিলে জমিটা দিয়েছিলেন। ৫টি খতিয়ানে ও প্রায় ৬০টি প্লটে ভাগ করা। পরে বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে যায়।”
‘ধামাচাপা’ জমির কিছু অংশে আপাতত আলু, ধান চাষ করছেন নারায়ণ রায়, নীরেন বর্মন, তপন ঘোষের মতো স্থানীয় কিছু কৃষক। জমিটা তো সরকারের! ওঁরা বলছেন, “এত দিন ধরে তো খালিই পড়ে আছে! কেউ আসে না। বরং বহু লোক এসে মাটি কেটে নিয়ে যায়! আমরা চাষ করলে
দোষ কোথায়?” |