প্রবন্ধ ২...
রাষ্ট্রপতি ভবন রাজনীতির বাইরে
এই দলীয় কাজিয়া অশোভন
ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্ব ক্রমশই এক কুনাট্যের জন্মদাতা হতে চলেছে। সাংবিধানিক বিচারে রাষ্ট্রপতি প্রকৃত শাসক নন। সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আনুষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক। কোনও প্রকার দলীয়তা তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রের প্রধান। এ হেন ব্যক্তির নির্বাচন প্রক্রিয়ার যাতে দলীয় অবস্থান কোনও প্রকার গুরুত্ব লাভ করতে না পারে, সে জন্যই সংবিধানপ্রণেতারা সচেতন ভাবেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে সাধারণ নির্বাচনের আকার দিতে চাননি। সাধারণ নির্বাচনে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনের প্রশ্নটি জড়িত বলে দলীয় মতাদর্শ বা কর্মসূচিগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা একান্ত কাম্য। সে ক্ষেত্রে নির্বাচকমণ্ডলী প্রকৃত শাসক নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক অবস্থানকে গুরুত্ব দেবেন এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সংবিধান প্রণেতারা এই জন্যই দু’ধরনের নির্বাচন প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি প্রকৃত শাসক হওয়ার জন্য তাঁর ইলেকটোরাল কলেজ বা নির্বাচকমণ্ডলী সরাসরি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। এমনকী দু’টি প্রধান দলের কে কে প্রার্থী হবেন তা-ও ওই দলগুলির নথিভুক্ত প্রতিনিধিরা স্থির করেন। আমাদের দেশে এতটা অন্তর্দলীয় গণতন্ত্র আশা করা অন্যায়। কিন্তু ভারতের রাষ্ট্রপতি নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হওয়ার জন্য এখানে ইলেকটোরাল কলেজ গঠন করেন কেন্দ্র ও রাজ্য আইনসভাগুলির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই। নির্বাচন প্রক্রিয়াও জটিল এবং বহুস্তরীয়। প্রক্রিয়াগত অবস্থানে এমন কোনও প্রকার উপাদান নেই, যার দ্বারা নির্বাচকমণ্ডলীর উপর সরাসরি দলীয় হুইপ জারি করা যায়।
অর্থাৎ, অত্যন্ত নির্দিষ্ট ভাবে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর নির্বাচনকে বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থান নিরপেক্ষ রাখার একান্ত চেষ্টা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি যেহেতু সরকারের নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করতে পারেন না, তাই প্রাক্-নির্বাচনী পর্বে তাঁর কোনও দায় নেই দলীয় নীতি ও কর্মসূচি প্রচার করার। প্রার্থীর দলেরও তাঁর উপর অতি মাত্রায় দলীয় পরিচিতি আরোপ করা উচিত নয়। বিভিন্ন প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতেই পারে, কিন্তু তা কখনওই সাধারণ নির্বাচনের মতো রাজনৈতিক রূপ ধারণ করা বাঞ্ছনীয় নয়। অর্থাৎ, ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ইউপিএ প্রার্থীকে এনডিএ-র কোনও শরিক বা এনডিএ প্রার্থীকে ইউপিএ-র কোনও শরিক ভোট দিলে (মহা)ভারত অশুদ্ধ হওয়ার কোনও আশঙ্কা নেই। সবাই মিলে বিবেক-ভোট দিলেও কিছু এসে যায় না।
অথচ ঘটমান বর্তমানে ঠিক এই জায়গাতেই একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কংগ্রেস প্রার্থী প্রণব মুখোপাধ্যায় বা বিজেপি প্রার্থী পি এ সাংমা উভয়েই এমন ভাবে রাজ্যে রাজ্যে প্রচারে যাচ্ছেন এবং ভোট-ভিক্ষা করছেন যে অদূর ভবিষ্যতে যিনিই রাষ্ট্রপতি হোন, তাঁর প্রাক্-নির্বাচনী ভূমিকার কথা বিচার করলে পরিস্থিতি যথেষ্ট মর্যাদাসম্পন্ন হচ্ছে না। প্রণববাবুর বিষয়টি গভীর বিশ্লেষণ দাবি করে। সাংমা যেহেতু তাঁর নিজের দল ছেড়ে এসেছেন, তাই দলীয়তার ক্ষেত্রে তিনি একটু ব্যাকফুটে। বিজেপি, বিজেডি বা এ আই ডি এম কে সাংমা যে দলেরই মৌলিক প্রার্থী হোন, ‘সই’ বিতর্ক নিয়ে কূটকচালি করা বা নেতা-নেত্রীদের সামনে ঘাড় কাত করা ছাড়া তাঁর বিশেষ কিছুই করার নেই। আরও নেই কারণ, কংগ্রেস নেতা-নেত্রীরা উচ্চকণ্ঠে বলে চলেছেন, কারও সাধ্যি নেই প্রণববাবুকে হারায়।
এত যাঁর শক্তি এবং এত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যিনি বাঘ ও গরুকে বহু বার এক ঘাটে জল খাইয়ে ছেড়েছেন, সেই প্রণববাবুর কী প্রয়োজন হয়েছিল রাজ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক প্রচারের ঢঙে প্রায় জনসভা বহন করে ভোটভিক্ষা করে বেড়ানোর?
প্রশ্নটি জরুরি, কারণ আমরা দেখছি, ভারতের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রপতি ভোট প্রচারে বেরিয়ে কী কাণ্ডই না ঘটাচ্ছেন! উত্তরপ্রদেশে তাঁর সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া ভোজ খেতে খেতে বেরিয়ে আসছেন মুখতার আনসারি ও বিজয় মিশ্র নামক সমাজবাদী পার্টি সমর্থিত দুই অভিযুক্ত বিধায়ক। আনসারি সরাসরি খুনের আসামি। ভোজ খেয়ে তিনি দিব্যি জেল হাসপাতালের বিছানায় শয্যাশায়ী।
এ তো হল টুকটাক বিষয়। এ দেশে ‘এমন তো কতই ঘটে’। রাজনৈতিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাও তো ঘটছে। বামপন্থীদের ঐক্য ভেঙে দিয়েছেন প্রণববাবু। আলিমুদ্দিনে একটা ফোনই যথেষ্ট। কংগ্রেস-তৃণমূলে ভাঙন ধরানোর জন্য বঙ্গ-ব্রিগেড রীতিমত প্রকাশ কারাটকে দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়েছে। শুধু কি তাই! কারাট-ঘনিষ্ঠ তাত্ত্বিক যুব নেতাকে কুলোর বাতাস দিয়ে তাড়ানো হয়েছে দল থেকে। বামেদের দুই ছোট শরিক সি পি আই এবং আর এস পি (বেচারা, ভোটের জোর নেই) যতই আপত্তি তুলুক, তার কোনও মূল্যই নেই।
আগে যাঁরা রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তাঁরা কেউই এমন প্রাক্-নির্বাচনী প্রচারে নামেননি। ১৯৬৯ অন্য ব্যাপার ছিল, কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন স্বয়ং ইন্দিরা। কিন্তু এই সর্বব্যাপী প্রচার ও তার অভিঘাতে রাজনৈতিক বিতর্ক একান্তই অপ্রয়োজনীয় ও অভূতপূর্ব। এতে রাষ্ট্রপতি বা সেই পদের প্রার্থীদের মর্যাদা বাড়ে না। বস্তুত, রাজনৈতিক রাষ্ট্রপতিদের এ দেশের মানুষ স্মরণেই রাখেন না। হৃদয়াসনে থাকেন সর্বেপল্লি রাধাকৃষ্ণন, জাকির হুসেন বা এ পি জে আবদুল কালাম।
যত মর্যাদাবোধ কেবল তৃণমূল নেত্রীর প্রশ্নে। এতটাই যে, কংগ্রেসের বিভিন্ন স্তরের নেতা বা কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা তাঁর হয়ে রীতিমত ধমক-চমক দিয়ে বেড়াচ্ছেন। নরমে-গরমে চাপ বাড়াচ্ছেন রাজ্য সরকারের উপর। প্রণববাবু যেন দলীয় সভাপতি হতে চলেছেন, এমনই ভাব তাঁদের! না হলে তাঁর প্রার্থিপদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে কেউ মিছিল বার করে? এহ বাহ্য! সবচেয়ে আশ্চর্যজনক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকা। এত বঙ্গপ্রেমী অথচ চিদম্বরম মশাই যখন আমাদের রাজনীতিকে ‘হিংসার সংস্কৃতি’ বললেন, আমরা রাগলাম না। বাঙালি রাষ্ট্রপতির জন্য হেদিয়ে মরা বুদ্ধিজীবীকুল বেবাক চুপচাপ!
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবিধানিক এক্তিয়ার তো লঙ্ঘন করেছেনই। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে গেছে যে-অনৈতিকতা, তা হল তৃণমূল বিধায়ক ও সাংসদদের উপর চাপ তৈরি এবং তাতে নিজের পদকে ব্যবহার করা। দেশ জুড়ে নানা সময়ে বিভিন্ন কারণে হিংসার বাতাবরণ তৈরি হলেও একটি জনসমষ্টির সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি এর আগে এ ভাবে আক্রান্ত বা নিন্দিত হয়নি। প্রার্থী তো প্রায় জিতে গেছেন! তৃণমূলের ভোট অপ্রয়োজনীয়। তবু এই অনৈতিক দলীয় চাপ যখন ঘটে, আশঙ্কা হয়, সাধারণ নির্বাচনে যেখানে প্রার্থীর জয়লাভ অনিশ্চিত, সেখানে কী পরিমাণ চাপ দিতে সক্ষম এই রাজনৈতিক কাঠামো। বুঝতে পারি, কেন ভোটের আগে সাধারণ মানুষ মুখ খোলেন না, বা ভোটের পর কেনই বা আক্রান্ত হন। একেই বলে বিন্দুতে সিন্ধু দর্শন।

বঙ্গবাসী কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.