প্রবন্ধ ১...
বাঙালি কি সত্যই আত্মঘাতী? কে জানে
মুক্তিযুদ্ধের একেবারে প্রথম পর্ব— বাংলাদেশে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পাকিস্তানি সেনানী যে বীভৎস হত্যালীলা চালিয়েছিল তা থেকে কোনও ক্রমে নিজেকে বাঁচিয়ে দুই ঘনিষ্ঠ অধ্যাপক বন্ধু আগরতলা-কলকাতা ছুঁয়ে দিল্লি পৌঁছে কিছু দিন আমার বাসগৃহে অতিথিরূপে ছিলেন। তাঁদের অন্যতম ঢাকার নবাব পরিবার বংশোদ্ভূত। সেই কাশ্মীরি পরিবারে আদৌ বাংলা ভাষার চর্চা ছিল না। কদাপিও ছিল না। বন্ধুটিও ভাঙা-ভাঙা বাংলা বলতেন অতি আড়ষ্ট উচ্চারণে। তাতে কী, তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে একাত্ম ভাবে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ-ঘোষণাকারী রাজনৈতিক নেতাদের বরাবরই ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতা। নতুন দিল্লিতে বৈদেশিক তথা সার্বিক জাতীয় নীতির যাঁরা প্রধান নিয়ামক, তাঁদের সঙ্গে বন্ধুদের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া গেল। ভারতের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কুশীলবগণের বিনিময়-প্রতিবিনিময়ের সেটাই প্রথম যোগসূত্র। অথচ বন্ধুদ্বয়ের মনে তখনও দ্বিধা, ঢাকায় তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের রেখে এসেছেন, এখানে তাঁরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন, সেই খবর ছড়িয়ে পড়লে তাঁদের ঢাকায়-পড়ে-থাকা-আত্মজনদের বিপদ হতে পারে। তাই বন্ধুবররা আপাতত ছদ্মনামের আড়ালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ঢাকার নবাব পরিবার বংশীয় বন্ধুটি উৎসাহে টগবগ করছেন, বঙ্গভাষী না-হয়েও বাঙালি স্বপ্নমেদুরতায় সুমগ্ন। তিনি নিজের নাম বাছলেন, মোহনলাল। বাঙালিদের গর্ব-করা প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধে যিনি সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন, যেন সুহৃদ্বর তাঁর নব অবতার।
অর্ধেক ইতিহাস তুমি। পলাশীর যুদ্ধের ২৫১ বছর পূর্তিতে নাট্যানুষ্ঠান। পলাশী, ২০০৮
বন্ধুটির রোমান্টিক উচ্ছ্বাসপনায় আঘাত দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই ছিল না। তাই তাঁকে বলতে পারিনি, নবীনচন্দ্র সেনের ‘পলাশীর যুদ্ধ’ কাব্য এবং শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদ্দৌল্লা’ নাটক যে কিংবদন্তি প্রচার করুক, মোহনলাল মোটেই বঙ্গদেশীয় ছিলেন না। যেমন ছিলেন না স্বয়ং আলিবর্দি খাঁ কিংবা তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌল্লা অথবা তাঁদের বিশ্বাসহন্তা মন্ত্রী মীরজাফর। তাঁরা বাংলাদেশের নবাব-সুবেদার ছিলেন, নবাবের দরবারে মন্ত্রী-সেনাপতি-অমাত্যরূপে কিন্তু বাঙালি ছিলেন না, বাংলা ভাষার সঙ্গে তাঁদের কোনও পরিচয়ই ছিল না। মোহনলালও, নাম শুনে মনে হয়, পঞ্জাব অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষণে আসেন, ক্রমে নবাব বাহাদুরের সেনাধিপতি হয়ে ওঠেন। আমাদের স্বদেশ-চেতনা উন্মীলনের উষা-মুহূর্তে জাতীয় অস্মিতাবোধের আকুলতায় ইতিহাস হাতড়ে আমরা অনুপ্রেরণা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম। পলাশি-প্রান্তরে ইংরেজদের কাছে নবাবের সৈন্যবাহিনীর শোচনীয় পরাজয়কে কেন্দ্র করে একটি বিয়োগান্ত কাহিনি রচনা করে ঈষৎ তৃপ্তি আহরণের চেষ্টা: সিরাজউদ্দৌল্লা মোহনলালকে নিয়ে বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম চমৎকার চালিয়ে যাচ্ছিলেন, সফলও হতেন, যদি না শেষ মুহূর্তে ওই লক্ষ্মীছাড়া মীরজাফর-আমিনচাঁদের দল অমন ঘৃণ্য বিশ্বাসঘাতকতা করত।
উপাখ্যানের জলতরঙ্গ কে রোধ করবে? আত্মঘাতী বাঙালি মহাপ্রসঙ্গের তখন থেকে সূচনা। বাঙালি-সংবেদনার সঙ্গে এই সংস্কার মসৃণ মিশে গিয়েছে বাঙালিরাই বাঙালিদের সবচেয়ে বড় শত্রু, এক বাঙালি অন্য বাঙালির যশ-মান-বিত্তের প্রসার সহ্য করতে পারেন না, কুচুটেপনায় প্রবৃত্ত হন, নিজেদের মধ্যে যিনি জাগতিক অর্থে ঈষৎ সফল হয়েছেন, তাঁকে যে করেই হোক টেনে নামানোর অধ্যবসায়ে খামতি নেই। এক অতি সফল বাঙালি, নীরদচন্দ্র চৌধুরী মহাশয় তাঁর প্রথম জীবনে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন, কলকাতার তথাকথিত বিদগ্ধ সমাজ দ্বারা দীর্ঘদিন উপেক্ষিত ছিলেন। কেউ কেউ কুটনি কাটেন, সেই অভিমানেই সম্ভবত জীবনের উপান্তে, বিদেশে নিশ্চিন্তে স্থিত হয়ে, ‘আত্মঘাতী বাঙালী’ শিরোনামে গ্রন্থ রচনা করেন।
উপপ্রসঙ্গটি আপাতত উহ্য রেখে মূল বিষয়ে ফিরি। সেই যে রবীন্দ্রনাথ এক বার লিখেছিলেন, কোনও কিছু যদি সমাজের অধিকাংশ মানুষের পছন্দসই হয়, তা হলে তা নিয়ে যদি কেউ মৃদুতম আপত্তিও জ্ঞাপন করেন, সেই ব্যক্তির উপর তাঁরা হাড়ে হাড়ে চটে যান। ‘বাঙালি আত্মঘাতী’ তত্ত্বটি বাঙালি সমাজ স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে গ্রহণ করেছেন, কার ঘাড়ে ক’টা মাথা, অন্য রকম বলে! যেহেতু এইমাত্র রবীন্দ্রনাথের নামোল্লেখ করেছি, তাঁকে নিয়েই একটা-দুটো কথা নিবেদন করি। তিনি যত দিন বিদেশিদের ওই মহার্ঘ সিলমোহরটি না পেয়েছিলেন, তাঁর সমালোচকের অভাব ছিল না। অনেক ক্ষেত্রেই সে সমালোচনা যুক্তিহীন, তথ্যপ্রমাণলঘু, নিন্দার জন্যই যেন নিন্দা বর্ষণ। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি সম্প্রদায়ের কথা না-হয় ছেড়েই দিলাম। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় স্বয়ং নিজে এত প্রতিভাদীপ্যমান সৃষ্টিশীল পুরুষ, অথচ রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অসূয়াবোধ চেপে রাখতে পারেননি, খেলো ব্যঙ্গবিদ্রুপে তাঁর একদা ঘনিষ্ঠ সুহৃদকে বিধ্বস্ত করতে প্রয়াসবান হয়েছেন। ‘আমি নিশিদিন তোমায় ভালবাসি তুমি leisure মাফিক বাসিও’ গোছের খেলো গান বেঁধেছেন, ‘আনন্দ বিদায়’-এর মতো কদর্য প্রহসনে, বাঙালি যে চরম আত্মঘাতী, তা প্রমাণ করতে তাঁর যেন সবুর সইছিল না। অথচ দেখুন, তোপের মুখ কিন্তু বিপরীত দিকেও ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।
এবং দেওয়া হয়েছে। দেশ জুড়ে, দেশ ছাপিয়ে বিদেশেও রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতজন্মবর্ষ পালন মহা ঢাকঢোল পিটিয়ে সদ্য শেষ হয়েছে। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলাল রায়েরও জন্মের সার্ধশত বছর ছিল এটা। তাঁর কথা বলতে গেলে একেবারেই আমাদের মনে পড়েনি। স্বদেশচেতনার উন্মেষে রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা-প্রবন্ধ-উপন্যাস যতটা উদ্দীপক, একটি বিশেষ পর্বে বাঙালি সমাজ কি দ্বিজেন্দ্রলালের অগণিত নাটকগুলি থেকে অন্য আর এক ধরনের জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়নি? রবীন্দ্রনাথ রচিত ভূরি ভূরি দেশাত্মবোধক গানের মধ্যে একটি স্বাধীন ভারতের জাতীয় সংগীত, অন্য একটি স্বাধীন বাংলাদেশের। পৃথিবীর ইতিহাসে এমনটি আর হয়নি। তবু কী করে ভুলে থাকি কিন্তু ভুলে তো আছিই যে দ্বিজেন্দ্রলাল এক দিকে যেমন ‘যেদিন সুনীলজলধি হইতে উঠিলে জননী ভারতবর্ষ’-র মতো উদাত্ত সংগীত লিখেছেন, পাশাপাশি লিখেছেন, ‘বঙ্গ আমার জননী আমার, ধাত্রী আমার আমার দেশ’ এবং ‘ধনধান্যপুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা... তাহার মাঝে আছে সে এক সকল দেশের সেরা’, কিংবা ‘গিয়াছে দেশ, দুঃখ নাই, আবার তোরা মানুষ হ’। এখানেই শেষ নয়, তাঁর সংগীতপ্রতিভা দেশি-বিদেশি ধ্রুপদী ঐতিহ্য থেকে শুরু করে কীর্তন-বাউলের অঙ্গন ডিঙিয়ে লোকায়ত সংগীতের নানা বিচিত্র ধারার মিশ্রণ-সন্ধি-সমাস-সম্ভাবনা অনুধ্যান শেষে যে-সব আশ্চর্য সৃষ্টি একদা করেছিল, তাঁর পুত্রের প্রয়াণের পর সে সমস্ত নিয়ে আর কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। একটি মস্ত মণিমাণিক্য-ভাণ্ডার আমরা পরম অন্যমনস্কতা তথা গভীর অবহেলাভরে মাটিতে পুঁতে দিয়েছি। এখানেও কিন্তু বাঙালির স্বভাব-আত্মবিস্মরণ-প্রবণতার একটি প্রমাণ মেলে। কেউ হয়তো বলবেন, ইতিহাসের প্রতিশোধ দ্বিজেন্দ্রলাল যেমন একদা রবীন্দ্রনাথের অবমাননা সাধন করেছিলেন, রবীন্দ্র-আপ্লুত বাঙালি সমাজ তেমনই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে ভুলে মেরে দিয়েছে। একটি সমস্যা তো তা হলেও থেকেই গেল, রবীন্দ্রপ্রতিভার অতলতা এখন তো সর্বজনস্বীকৃত, অন্য পক্ষে দ্বিজেন্দ্র রচনাবলির হদিশ পেতে এখন গ্রন্থশালা নয়, প্রায় জাদুঘরের দ্বারস্থ হতে হয়।
ইতিহাসকে আরও একটু এগিয়ে আসতে দিন এবং সাহিত্যপ্রসঙ্গ অতিক্রম করে রাজনীতির গহনারণ্যে অনুপ্রবেশ করা হোক। ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরী অধিবেশনের অব্যবহিত উত্তরকালে যে ষড় করে সুভাষচন্দ্রকে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদ ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়, সেই চক্রান্তে কিন্তু খাস বঙ্গভূমির কয়েক জন রাঘব-বোয়াল নেতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ছিলেন। অথচ কোনও আলোচনাতেই তাঁদের বিশ্বাসঘাতক বলে অভিহিত করা হয় না। তারই মাত্র এক বছর পরের একটি ঘটনা উল্লেখ করি: সুভাষচন্দ্র বুঝতে পারছিলেন, কয়েক বছর আগে ফজলুল হক তাঁর কৃষক প্রজা দলের সঙ্গে মিতালি করে জাতীয় কংগ্রেসকে প্রাদেশিক সরকারে যোগ দেওয়ার যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তা প্রত্যাখ্যান করা মস্ত অবিবেচনার কাজ হয়েছিল, পরিণতিতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে আড়াআড়ি বাড়ছিল। এ ভাবে চলতে থাকলে সর্বনাশ হবে, সুভাষচন্দ্র তাই মুসলমান সম্প্রদায়কে কাছে টানার জন্য বহুবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। হলওয়েল মনুমেন্ট সংক্রান্ত কালিমা বিলোপের দাবিতে আন্দোলনে নেমে, হাতে প্রতীকী হাতুড়ি-বাঁটলি নিয়ে হাজার-হাজার কর্মী রাস্তায় নেমে কলকাতা কাঁপিয়ে দিলেন, আন্দোলন সফল হল, ইংরেজ প্রভুরা কুৎসা-ভিত্তিক স্মৃতিফলক অপসারণে বাধ্য হলেন। কাছাকাছি সময়ে কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনে সুভাষচন্দ্র নিজের উদ্যোগে মুসলিম লীগের সঙ্গে বোঝাপড়া করে যুক্ত প্রার্থী-তালিকা নির্ণয় করলেন, নিবার্চনে সফল হয়ে মেয়রের পদটি মুসলিম লীগকে ছেড়ে দিলেন। গোঁড়া জাতীয়তাবাদী মহলে ঢি-ঢিক্কার পড়ে গেল। বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রে বড় করে ব্যঙ্গচিত্র ছাপা হল ধুলোমাখা ফতুয়া, খাটো লুঙ্গি পরা, হাতে রক্তাক্ত ছুরি, গালে খচখচ দাড়ি, মাথায় বাঁকা করে পরা জিন্না টুপি, ছুবাছ মিঞা অবনতমস্তকে দাঁড়ানো, তাঁকে আচার্য ইস্পাহানি (সে-সময়কার কলকাতাস্থ মস্ত ব্যবসায়ী ও মুসলিম লীগের চাঁই) কমণ্ডলু থেকে জল ছিটিয়ে আশীর্বাদ করছেন। সুভাষচন্দ্রের দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা নিয়ে যাঁরা সে দিন ঘৃণাত্মক কৌতুকের বন্যা বইয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের কেন আত্মঘাতী বাঙালি বলে অভিহিত করা হয় না?
ছ’সাত বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই দেশভাগের, সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ফের দু’টুকরো হওয়ার, অবশ্য-সম্ভাবনা। সুভাষচন্দ্রের অগ্রজ শরৎচন্দ্র বসু এই পরিস্থিতিতে একটি শেষ চেষ্টা করলেন। আবুল হাশেম ও শহিদ সুরাবর্দির সঙ্গে মিলে স্বাধীন বাংলাদেশ স্থাপনের জন্য আন্দোলনে ব্রতী হলেন। তাঁর কথা কেউই মানলেন না, দিল্লিতে কংগ্রেস কর্তৃপক্ষ তো নয়ই। গোটা বাংলা জুড়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন মুখপাত্রদের অধিকাংশও। শরৎচন্দ্র কি মূল স্রোতের বিপরীতে গিয়ে আত্মঘাত-প্রয়াসী বাঙালিদের তালিকায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন? না কি ইতিহাসের বিচার অন্য কথা বলবে, তিনি যে পথের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তা অনুসরণ করলে, কেউ কেউ এখন বলছেন, হয়তো পরিণামে বাঙালিদের সামগ্রিক শুভই সাধিত হত। এই বিতর্ক চলছে, চলবে, শেষ কথা বলার কে অধিকারী, তা আমরা জানি না।
অনেক কাসুন্দি ঘাঁটা হল। এ বার প্রত্যক্ষ বর্তমানে পৌঁছনো যাক। গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না, এই প্রবচন দুর্মর, কিন্তু এই মুহূর্তে এই রাজ্যের বাঙালিরা বোধ হয় প্রবচনটিকে কুচি কুচি করে কর্তন করতে উদ্গ্রীব। তাঁরা একটি অতি বিশেষ নির্বাচন উপলক্ষে লক্ষণাদি দেখে মনে না হয়েই পারে না, দেখিয়ে দেবেন গেঁয়ো প্রার্থী অন্তত কাঁড়ি কাঁড়ি ভোট পায়। তবে কি অবশেষে প্রমাণিত হবে, বাঙালি আত্মঘাতী নয়, বরঞ্চ নীরদ চৌধুরী মশাই-ই কুচুটেপনা-সহ স্বজাতিনিন্দায় ব্যাপৃত হয়েছিলেন, তিনি নিজেই আত্মঘাতীপ্রধান?
অত সহজে কিন্তু মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়ার নয়। কয়েক সপ্তাহ আগে নিঃসঙ্গ প্রবাসে গত শতাব্দীর, প্রধানতম না হলেও, অবিসংবাদিত অন্যতম প্রধান ভারতীয় আলোকচিত্রশিল্পী, সুনীল জানা, প্রয়াত হয়েছেন। কলকাতার বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু কোনও সংবাদপত্রে কিংবা কোনও কলকাতা-কেন্দ্রিক টেলিভিশন চ্যানেলে তাঁর প্রয়াণের কোনও উল্লেখ ছিল না, চেন্নাই ও দিল্লি থেকে প্রকাশিত দুটি দৈনিকে খবরটি ছাপা হওয়ার পরই কলকাতার টনক নড়ে। আজ থেকে সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগে বাঙালি ঘরে ঘরে তাঁর তোলা দুর্ভিক্ষের মর্মান্তিক ছবি নিয়ে আলোচনা হত, সেই সব ছবিই বাংলার মন্বন্তরের করাল-নিষ্ঠুর-বীভৎস রূপটি পৃথিবীর কাছে উদ্ঘাটিত করে। পঞ্চাশের দশকে সুনীল জানা দেশের নিবিড়তম অরণ্যাঞ্চলে অশেষ পরিশ্রম সহকারে ঘুরে ঘুরে আদিবাসীদের জীবনচর্যার মনোমোহিনী তথাচ করুণ আলেখ্য ক্যামেরাবন্দি করে তথাকথিত শহুরে ভদ্রলোকদের জ্ঞানচক্ষু খুলে দিয়েছিলেন, এ শহর ও শহর জুড়ে আলোচনা-বিশ্লেষণ-বাদানুবাদ। দক্ষিণ কলকাতার লেক মার্কেট অঞ্চলে অবস্থিত তাঁর স্টুডিয়োয় শিল্প-চিন্তা-কলা-সাহিত্যের বাঘা বাঘা মানুষজন আড্ডায়-তর্কে ফিকে অপরাহ্ণ থেকে মধ্যনিশীথ পর্যন্ত নজরুল-কথিত সৃষ্টিসুখের উল্লাসে ভেসে যেতেন। সময় পাল্টায়, যুগের স্বভাব বদলায়, সুনীল জানা এখন অচেনা নাম, তাঁর মৃত্যু নিয়ে কোনও হেলদোল নেই। বাঙালি কি আত্মঘাতী? কে জানে?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.