জনপ্রিয় একটি চলচ্চিত্র কিছুতেই দূরদর্শনে সম্প্রচার করা যাইতেছে না। অন্তত রাত্রি এগারোটার আগে ‘ডার্টি পিকচার’ প্রদর্শন সম্ভব নয়। কারণ চলচ্চিত্রটিতে নাকি এমন কিছু দৃশ্য ও সংলাপ রহিয়াছে, যাহা রাত্রি এগারোটা পর্যন্ত জাগিয়া থাকা দর্শকদের পক্ষে পরিপাক করা কঠিন। তাঁহারা যাহাতে অগ্নিমান্দ্য হইতে না ভোগেন, সে জন্যই গত এপ্রিলে চলচ্চিত্রের প্রযোজকরা ৫৯টি স্থানে স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া কাঁচি চালাইয়াছিলেন। তথাপি সেন্সর বোর্ডে কর্তাদের মনে হইয়াছে, একটি নাবালক জাতির পক্ষে ছবিটির প্রদর্শনী বিষম গুরুপাক হইয়া যাইবে। অথচ প্রযোজকরা চাহেন যত অধিকসংখ্যক দর্শককে সম্ভব ছবিটি দেখাইতে। তাই আরও ৪১টি অংশে কাঁচি চালাইয়া চলচ্চিত্রটিকে নিরামিষ, সর্বজনভোগ্য পবিত্র প্রদর্শনীতে পরিণত করা হইয়াছে। এই চূড়ান্ত শোধনবাদ অন্তে অতঃপর নাবালকদের দূরদর্শন দেখার সময়ে অর্থাৎ ‘প্রাইম টাইম’-এও ছবিটি প্রদর্শন করা যাইবে।
দূরদর্শন তথা সেন্সর বোর্ডের কর্তারা নিশ্চয়ই মনে করেন, ‘পিকচার’টি যথার্থই নোংরা। তাহা না হইলে উহার এতগুলি অংশে তাঁহারা কাঁচি চালাইতে বলিবেন কেন? কেন সংশোধন ও শুদ্ধির সম্মার্জনী প্রয়োগে সংস্কৃতির অঙ্গন হইতে ‘এত্তা জঞ্জাল’ বিদায় করিতে উদ্যত হইবেন? লক্ষণীয়, চলচ্চিত্রটি জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত। তাহা করা হইল কী বিচারে? কাহারাই বা বিচারক ছিলেন? তাঁহাদের কি এক বারও মনে হয় নাই যে, এত ‘ডার্টি’ একটি ‘পিকচার’ দেশবাসীকে দেখিতে দিলে তাহাদের চরিত্র নষ্ট হইতে পারে? যাহা দেখিয়া দেশের নাবালকরা বিচলিত, ভ্রষ্ট, স্খলিত হইতে পারে? এই শঙ্কা কেবল সেন্সর বোর্ডের জ্যাঠামহাশয়দের, যাঁহারা সংস্কৃতি-পুলিশ রূপে কাজ করিতে দীর্ঘ কাল ধরিয়া অভ্যস্ত? জনরুচি নির্ধারণ করার একতরফা ও স্বৈরাচারী ক্ষমতা ভোগ করিতে অভ্যস্ত এই সাংস্কৃতিক ডাইনোসরগুলি কেন্দ্র ও রাজ্যের তথ্য-সম্প্রচার বা তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রকের ক্ষমতার অলিন্দগুলির দখল লইয়াছে। পরিবর্তিত সময়, বিবর্তনশীল যুগধর্ম, কিছুই তাঁহাদের শিলীভূত মগ্নচৈতন্যকে আন্দোলিত করে না। দেশবাসীকে তাঁহারা মনে করেন অপ্রাপ্তবয়স্ক কিছু নাগরিক, যাহাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষিত রাখা তাঁহাদের পবিত্র দায়। আর সে দায় পালন করিতে গেলে যাবতীয় ‘ডার্টি’ বিষয় হইতে নাবালক দেশবাসীকে দূরে রাখিতে হইবে। জীবাণুনাশক দিয়া শোধন না করিয়া কোনও সংস্কৃতি তাঁহাদের সেবন করা যাইবে না।
জনরুচিকে এ ভাবে পাহারা দেওয়া, রক্ষণশীলতার ঘেরাটোপে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উন্মেষশালিনী বিকাশকে অবরুদ্ধ করার এই অপপ্রয়াস একান্ত ভাবেই গণতান্ত্রিক বহুত্ববাদের ভাবনার পরিপন্থী। বহুত্ববাদ দাবি করে শত পুষ্পের অবাধ বিকাশ। সুগন্ধি পুষ্পের সহিত বিষাক্ত আগাছাও সেখানে জন্মাইতে পারে। কোনটি বিষাক্ত আগাছা অর্থাৎ পরিত্যজ্য সংস্কৃতি, আর কোনটি সুগন্ধি পুষ্প অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর, উপকারী কলাবিদ্যা, তাহা উপভোক্তারাই নির্ণয় করিবেন, কোনও সেন্সর বোর্ড কিংবা সরকার নিযুক্ত কমিটি নয়। ‘ডার্টি পিকচার’ ডার্টি কি না, সেটা দর্শকদের বিবেচনার উপর ছাড়িয়া দেওয়াই ভাল। ডার্টি হইলেও দর্শকরা তাহা দেখিতে চাহেন কি না, সেই পছন্দের অধিকারও তাঁহাদের উপরেই ছাড়িতে হইবে। এমনিতেও যাঁহারা ওই ছবিটি দেখিতে আগ্রহী, এত দিনে কেব্ল টেলিভিশনের দাক্ষিণ্যে তাঁহারা সকলেই ছবিটি দেখিয়া ফেলিয়াছেন। কাটছাঁট ছাড়াই দেখিয়াছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব সারা বিশ্বে স্যাটেলাইট টেলিভিসশ, ইন্টারনেট ইত্যাদির যে জাল ছড়াইয়া দিয়াছে, তাহার প্রেক্ষিতে জনরুচি নির্ধারণে সেন্সর বোর্ডের ধারণাটিই জুরাসিক যুগের ধারণা বলিয়া গণ্য হইবে। তবে তাহাতেই বা আশ্চর্য হইবার কী আছে? ভারত তো একই সঙ্গে অনেক শতাব্দীর সহাবস্থানের দেশ। |