|
|
|
|
গুজরাত থেকে বাংলা দুরন্ত দৌড় বর্ষা-এক্সপ্রেসের |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
বর্ষার তুঘলকিপনায় নতুন মোড়! চলছিল মালগাড়ির গদাইলস্করি চালে। তার বদলে হঠাৎই একেবারে দুরন্ত এক্সপ্রেসের গতিতে দৌড়!
মৌসুমি বায়ু এ বার যে-ভাবে যাত্রা শুরু করেছিল এবং বিভিন্ন জায়গায় যে-ভাবে দফায় দফায় থমকে দাঁড়িয়ে থেকেছে, তাতে মনে হয়েছিল, গোটা দেশে তার ছড়িয়ে পড়তে জুলাই কেটে যাবে। কিন্তু হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে উঠে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই দেশ জুড়ে তার উপস্থিতি জানান দিল বর্ষা! সৌজন্য নিম্নচাপ। সুদূর গুজরাত থেকে পশ্চিমবঙ্গ সেই সৌজন্যের প্রমাণ পেয়েছে বুধবার। জোর বৃষ্টি হয়েছে প্রায় সর্বত্রই। সূচনায় বর্ষার ঢিমেতেতালা চালে বাংলায় চাষের ক্ষতি হয়েছে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে জুলাইয়ের বাকি সময়টা এবং অগস্ট জুড়ে দক্ষিণবঙ্গে এমন বৃষ্টিই চাইছেন কৃষকেরা।
লাভবান হচ্ছে দেশের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তও। সেখানে বর্ষার পৌঁছনোর কথা মরসুমের একেবারে শেষে। মৌসম ভবন জানাচ্ছে, সাধারণ ভাবে ১৫ জুলাই গুজরাতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে পৌঁছয় মৌসুমি বায়ু। এ বার কিন্তু ১১ জুলাই, অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের চার দিন আগেই সেখানে হাজির হয়েছে সে। কেরল দিয়ে মূল ভারতীয় ভূখণ্ডে বর্ষা ঢোকার কথা ১ জুন। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়তে সে সময় নেয় ৪৫ দিন। কেরলে এ বার চার দিন পরে ঢুকেছে বর্ষা। কিন্তু চার দিন আগেই সে পৌঁছে গেল গুজরাতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে। অর্থাৎ গোটা সফরে এ বার তার সময় লাগল ৩৭ দিন।
কিন্তু এটা কি ভাল? |
|
আবহবিদেরা বলছেন, বর্ষা কোথাও কোথাও কিছুটা দেরিতে পৌঁছলেও তেমন সমস্যা হয় না। সমস্যা হয় বর্ষার ভারসাম্য নষ্ট হলে। এ বার যেটা হচ্ছে। কোথাও বর্ষা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেছে দীর্ঘদিন ধরে। কোথাও দীর্ঘ সময় সক্রিয় থেকেছে নিম্নচাপ অক্ষরেখা বা ঘূর্ণাবর্ত। তাই উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং জেলায় অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়েছে এবং হয়েই চলেছে। আবার উত্তরবঙ্গেরই অন্য তিন জেলা মালদহ এবং দুই দিনাজপুরে বর্ষা এ বার অতি কৃপণ।
এক আবহবিদের ব্যাখ্যা, গত রবিবার মৌসুমি বায়ু ছিল পঞ্জাব-হরিয়ানায়। রাজস্থান টপকে তিন দিনে সে গুজরাতের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়ায় রাজস্থানের মরু অঞ্চলের কিছু অংশ বৃষ্টি পায়নি। সেখানে বর্ষা স্রেফ বুড়ি ছুঁয়েই চলে গিয়েছে। তাই রাজস্থানের গুজরাত সংলগ্ন অঞ্চলে ভারী বৃষ্টি হলেও জয়সলমেরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ফের ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠে গিয়েছে। এটা খারাপ লক্ষণ বলে মন্তব্য করেছেন ওই আবহবিদ।
লক্ষণ কতটা খারাপ, কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ারের বুধবারের মন্তব্যে তার আভাস আছে। তাঁর আশঙ্কা, কর্নাটক ও মহারাষ্ট্রে বৃষ্টি কম হওয়ায় বাজরা, জোয়ার ও ভুট্টার মতো দানাশস্যের উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে। তিনি জানান, গত ১০ দিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বর্ষণ বাড়লেও ওই দু’টি রাজ্যে বৃষ্টির পরিমাণ আশানুরূপ নয়। পওয়ারের কথায়, “দুই রাজ্যে যথেষ্ট বৃষ্টি না-হওয়ায় বাজরা, জোয়ার ও ভুট্টা চাষ নিয়ে আশঙ্কা থাকছে।” দানাশস্য রোপণ মাত্র ৫০ শতাংশ সম্পূর্ণ হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে তাঁর আশ্বাস, “রোপণের কাজ অগস্টের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চলতে পারে। ফলে এখনও কিছুটা সময় আছে।” খরিফ শস্যের উৎপাদন নিয়ে অবশ্য চিন্তার কিছু নেই বলে জানাচ্ছেন পওয়ার। তাঁর কথা, ধান এবং অন্যান্য খরিফ শস্য বপন চলছে। ওড়িশা ও ছত্তীসগঢ়ে ভাল বৃষ্টি হওয়ায় ধানের উৎপাদনে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। গুজরাত, মধ্যপ্রদেশেও গত দু’দিনে যথেষ্ট বৃষ্টি হয়েছে। ফলে বাদাম বা সয়াবিনের চাষেও সমস্যা হবে না।
কিন্তু উত্তর-পশ্চিম গুজরাতে আগেভাগে পৌঁছনোর পথে এত দিনের দুলকি চাল ছেড়ে বর্ষা হঠাৎ এ ভাবে দুরন্ত গতিতে দৌড় লাগাল কেন? মৌসম ভবনের এক আবহবিদের ব্যাখ্যা, বর্ষা কোথায় কখন পৌঁছবে এবং কোন অঞ্চলে কতটা বৃষ্টি নামাবে, তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট এলাকার বায়ুপ্রবাহের উপরে। কখনও ঘূর্ণাবর্ত, কখনও নিম্নচাপ অক্ষরেখা, কখনও বা নিম্নচাপ নির্দিষ্ট করে দেয় বর্ষার গতিবিধি।
গুজরাত থেকে শুরু করে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত এখন একটি নিম্নচাপ অক্ষরেখা বিস্তৃত রয়েছে। ওই নিম্নচাপ অক্ষরেখাটি তার দু’প্রান্তে খুবই সক্রিয়। তাই এ দিন গতিপথ পরিবর্তন করে হঠাৎই বর্ষা পৌঁছে গিয়েছে গুজরাতের শেষ প্রান্তে। ওই নিম্নচাপ অক্ষরেখার প্রভাবেই এ দিন প্রবল বৃষ্টি হয় উত্তরবঙ্গে। ভাল বৃষ্টি পেয়েছে কলকাতা এবং সংলগ্ন দক্ষিণবঙ্গও।
বর্ষার এই দুরন্ত-দৌড়ে বাংলা-সহ সারা দেশে এক ধাক্কায় ৭-৮% হারে বৃষ্টি-ঘাটতি কমে গিয়েছে। গত রবিবারেও দেশ জুড়ে বৃষ্টির ঘাটতি ছিল ৩০%। এ দিন তা কমে ২৩% হয়েছে। এ রাজ্যেও জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে উত্তরবঙ্গের তিন জেলা (মালদহ ও দুই দিনাজপুর) এবং দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বৃষ্টির ঘাটতি বেড়েই চলছিল। গত তিন দিনের বৃষ্টিতে অবশেষে দক্ষিণবঙ্গে বৃষ্টি-ঘাটতির পরিমাণ কমতে শুরু করেছে। দক্ষিণবঙ্গে গত রবিবার ঘাটতি ছিল ৪৬%। এখন কমে হয়েছে ৩৮%। নিম্নচাপ অক্ষরেখাটি যত দিন রাজ্যের উপরে থাকবে, তত দিন মাঝেমধ্যেই এ-রকম বৃষ্টি হবে বলে আবহবিদেরা আশ্বাস দিয়েছেন। |
|
|
|
|
|