মহেন্দ্র জেনা • শান্তিনিকেতন |
‘নির্যাতনের’ জেরে সে আর ফিরতে চায় না পাঠভবনে। ঘটনার তদন্তে গঠিত হয়েছে চার সদস্যের কমিটিও। অথচ যাকে ‘নির্যাতনের’ ঘটনায় দেশ তোলপাড়, পাঠভবনের সেই পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী বা তার বাবা-মায়ের সঙ্গেই কথা বলেনি তদন্ত কমিটি! যদিও কমিটির প্রাথমিক রিপোর্ট জমা পড়েছে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের কাছে। যা পৌঁছে গিয়েছে এমনকী প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়েও।
স্বাভাবিক ভাবেই কমিটির রিপোর্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ওই ছাত্রীর অভিভাবকেরা। বলছেন, “এ কী ধরনের তদন্ত কমিটি? যারা আমাদের সঙ্গে কথা না বলেই রিপোর্ট জমা দিয়েছে?” বিশ্বভারতীর উপাচার্য সুশান্ত দত্তগুপ্তের নির্দেশে এই তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন কর্মসচিব মণিমুকুট মিত্র। রিপোর্ট জমা দেওয়া নিয়ে কর্মসচিব মন্তব্য করতে চাননি। তবে বুধবার বোলপুরে ওই ছাত্রীর বাড়িতে গিয়ে আশ্বাস দেন, “পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট জমা পড়ার আগে ওই ছাত্রী ও তার বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলবে তদন্ত কমিটি।”
সোমবার সাংবাদিক বৈঠকে কর্মসচিব বলেছিলেন, “বিশ্বভারতীর নিরাপত্তা আধিকারিক ওই ছাত্রীর বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তাঁরা আসেননি।” বাবা-মায়ের ক্ষোভ, “সোমবার আমরা গ্রেফতার হয়েছিলাম। ওই সময়ে তদন্ত কমিটির সঙ্গে কি লক-আপে কথা বলতাম? জামিন পাওয়ার পরে কেন ওঁরা যোগাযোগ করেননি?” |
সেই ছাত্রীর বাড়িতে ৩ প্রতিনিধি। ছাত্রীকে জড়িয়ে ধরে কথা বলছেন
পাঠভবনের অধ্যক্ষা বোধিরূপা সিংহ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী |
এ প্রসঙ্গে বিশ্বভারতীর মুখপাত্র অমৃত সেন বা তদন্ত কমিটির চেয়ারপার্সন অরুণা মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেননি। জেলাশাসক জগদীশ প্রসাদ মিনার নির্দেশে এ দিন সন্ধ্যায় মেয়েটির বাড়িতে যান বোলপুরের মহকুমাশাসক প্রবালকান্তি মাইতি। জেলাশাসক বলেন, “সরকার, শিক্ষা দফতর এবং মহিলা ও শিশুকল্যাণ দফতর এ প্রসঙ্গে জানতে চেয়েছে। মহকুমাশাসককে তদন্ত-রিপোর্ট দিতে বলেছি।”
শনিবার বিছানা ভিজিয়ে ফেলার ‘অপরাধে’ তার নিজের প্রস্রাব চাটানোর অভিযোগ উঠেছে পাঠভবনের ‘করবী’ ছাত্রী নিবাসের ওয়ার্ডেন উমা পোদ্দারের বিরুদ্ধে। ঘটনার পরে এ দিন প্রথম ওই ছাত্রীর বাড়িতে যান বিশ্বভারতীর কর্মসচিব, পাঠভবনের অধ্যক্ষা বোধিরূপা সিংহ ও পাঠভবনের শিক্ষিকা নীলাঞ্জনা সেন। তাঁরা ওই ছাত্রীকে আদর করেন, তাঁর ভয় কাটানোর চেষ্টা করেন।
মেয়েকে পাঠভবনে ফের ভর্তি করানোর জন্য ছাত্রীটির বাবা-মায়ের কাছে অনুরোধও করেন। আশ্বাস দেন, এখানে ভর্তি করালে তাঁদের মেয়ের সমস্যা হবে না। এই আবেদনে সাড়া না দিয়ে মেয়েকে পাঠভবনে না পড়ানোর সিদ্ধান্তে অনড় ছাত্রীর বাবা-মা। এর উত্তরে অধ্যক্ষা বলেন, “যেখানেই হোক, মেয়েকে ভর্তি করিয়ে দিন। বাড়িতে বসে থাকলে ওর মানসিক অবস্থার উন্নতি হবে না।”
কী করবেন, ঠিক করেননি মেয়েটির বাবা-মা। দেশ জুড়ে তাঁদের মেয়ের প্রতি সহানুভূতি, সমর্থন বেড়ে চলেছে। শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত সর্বভারতীয় সংস্থার পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা অতীন্দ্রনাথ দাস বিবৃতিতে বলেন, ‘সার্বিক ভাবে শিশুদের প্রতি রাষ্ট্র ও সমাজের মানসিকতা বা মনোভাবে বদল ঘটানো যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, তা এই ঘটনায় স্পষ্ট। শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত আইনগুলিকে কাগজেকলমে না রেখে তা কার্যকর করা দরকার। তবে সবেচেয়ে জরুরি শিশুদের নিরাপত্তা সম্পর্কে সমাজের মনোভাব পাল্টানো’।
প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঢেউ আছড়ে পড়ছে ফেসবুকে। যাতে সামিল শর্মিলা রায় পোমো বা প্রমিতা মল্লিকদের মতো পাঠভবনের প্রাক্তনীরাও। সামিল খোদ পাঠভবনেরই প্রাক্তনী, বর্তমান অধ্যক্ষা বোধিরূপা সিংহ। যিনি ফেসবুকে লিখেছেন, ‘করবী ছাত্রীনিবাসের সাম্প্রতিক ঘটনা স্তম্ভিত ও মর্মাহত। আমরা সকলে ঘটনাটির তীব্র নিন্দা করি। পূর্বে এ রকম কখনও ঘটেনি, ভবিষ্যতেও যাতে না ঘটে, সে সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।’ একই সঙ্গে তাঁর আবেদন, এই ঘটনাকে যেন ‘বিচ্ছিন্ন’ হিসাবেই দেখা হয়। এ দিন ফোনে যোগাযোগ করা হলেও বোধিরূপাদেবী বলেন, “অভিযোগ তদন্তসাপেক্ষ। তবে এর জেরে মেয়েটির যে মানসিক অবস্থা হয়েছে, তার জন্য খারাপ লাগছে।” এত কিছুর পরেও ছাত্রীটি পাঠভবনে ফিরে আসবে বলে আশা পাঠভবনের অধ্যক্ষার। বলছেন, “কথা বলে যা মনে হয়েছে, ওই ছাত্রী তার পুরনো বন্ধুদের কাছে ফিরে আসবে।” |