বাহিরের সাজসজ্জা ঠিক থাকিলেই কি ভিতরের রক্তাল্পতা ও অন্তঃসারশূন্যতার নিরাময় হয়? হয় না। তথাপি বহিরঙ্গ সজ্জার উপর আমাদের মনোযোগের অন্ত নাই। মেডিক্যাল কলেজের স্বীকৃতি পাইতে পরিকাঠামোবর্জিত হাসপাতালগুলিতে রাতারাতি অন্য হাসপাতাল হইতে চেয়ার টেবিল, অপারেশন থিয়েটার, যন্ত্রপাতি, সাজসরঞ্জাম, ডাক্তার-নার্স (সম্ভব হইলে রোগীও) ভাড়া করিয়া আনিয়া পর্যবেক্ষকদের চোখে ধুলা দেওয়ার ব্যবস্থা এখন সরকার-অনুমোদিত। রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের আমলারা ইহাকে ‘কনে-দেখানো’ বলেন। এই পদ্ধতিতে অসম্পূর্ণ হাসপাতালের ভাগ্যে মেডিকাল কলেজের তকমাও জুটিয়া যাইতেছে। একই ভাবে গঙ্গার দূষণ রোধের জন্য বরাদ্দ ও অনুমোদিত বিপুল অঙ্কের কেন্দ্রীয় তহবিল দিয়া দূষণ রোধের কাজ করার পরিবর্তে কেবল নদীর পাড় বাঁধানো তথা তীর সাজানোর কাজ হইতেছে।
গঙ্গার দূষণ-রোধ বলিতে কী বুঝায়? নদী-বিশেষজ্ঞদের মতে, নদীতে পড়া নিকাশি নর্দমার মুখ বন্ধ করা কিংবা ঘুরাইয়া দেওয়া এবং নর্দমা-বাহিত তরল বর্জ্য শোধন করা-- এক কথায় বলিলে, রাজ্যের প্রধানতম জলপথটিকে সভ্যতার বর্জ্য বহনের নর্দমা হিসাবে ব্যবহার না-করা। এ জন্যই কল্যাণী হইতে বজবজ অবধি বিস্তৃত গঙ্গার দুই ধারের নিকাশি নালার সংস্কারে কেন্দ্র আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ বরাদ্দ করিয়াছে। রাজ্য সরকার প্রায় সব কাজেই অর্থাভাবের ওজর তুলিয়া থাকে। অথচ গঙ্গার দূষণ রোধের কেন্দ্রীয় তহবিল কী ভাবে খরচ করা হইতেছে? নদীতীরের সৌন্দর্যায়নে টাকা ঢালা হইতেছে। ইতিমধ্যে নদীবক্ষে রকমারি আবর্জনার স্তূপ ভাসিতে থাকুক। ‘কলিফর্ম’ জীবাণুতে নদী ভরিয়া যাক, মনুষ্য-উপভোগের অনুপযোগী হইয়া উঠুক, স্নানার্থীরা রোগাক্রান্ত হইতে থাকুক এবং রাসায়নিক ও অন্যান্য বর্জ্যের ঠেলায় ইলিশের ঝাঁকের গঙ্গাযাত্রা নিষিদ্ধ হইয়া যাক।
সৌন্দর্যায়নে কাহারও আপত্তি আছে বলিয়া মনে হয় না। কিন্তু অস্বাস্থ্যকর, রোগাক্রান্ত শরীরে পাউডার-পমেটম মাখিয়া কিংবা আতর-সুগন্ধি ছড়াইয়া যে কৃত্রিম আকর্ষণ তৈয়ার করা হয়, তাহা ক্ষণস্থায়ী। বাহিরের সাজসজ্জা চকচকে রাখার ব্যাপারে অর্থাৎ ‘কোঁচার পত্তনে’ বাঙালির এই যে তৎপর মানসিকতা, ইহা জীবনের সর্ব ক্ষেত্রেই তাহাকে আত্মপ্রতারণায় মগ্ন করিয়াছে। ভিতরে-অন্দরে যখন পচিয়া যাইতেছি, তখনও বাহিরের চটকে অন্যকে ভুলাইবার অভ্যাসে ক্রমশ আপনাকে ভুলাইবার সাধনাতেও প্রমত্ত হইতেছি। ভিতরে ‘ছুঁচোর কেত্তন’ ক্রমে কোলাহলময় হইতেছে। কলিকাতাকে কল্লোলিনী তিলোত্তমা করার বদলে লন্ডন বানানো কিংবা দার্জিলিংকে হিমালয়-রানি বানাইবার বদলে সুইজারল্যান্ড বানানোর অঙ্গীকারের মধ্যেও সেই একই আত্মপ্রবঞ্চনা স্পষ্ট। প্রায় কোনও ক্ষেত্রেই পরিকাঠামোর গুণগত উৎকর্ষ সাধনের দিকে নজর নাই, নজর কেবল বাহ্যিক চাকচিক্যের পরিমাণগত ব্যাপ্তির দিকে। তাই রাস্তা-ঘাটের খানাখন্দ বুজিতেছে না, কিন্তু গোটা শহর, শহরতলি সাজিয়া উঠিতেছে শাসকের পছন্দের বর্ণমালায়। পতিতোদ্ধারিণী গঙ্গা নিজেই একটি পতিত জলধারা হইয়া সভ্যতার যাবতীয় আবর্জনা বক্ষে ধারণ করিয়া চলিতেছে। আর আমরা তাহাকে দূষণমুক্ত করার বদলে তাহার পাড় সাজাইতেছি এবং সেই সজ্জাকেই দূষণমুক্তির আয়োজন দাবি করিয়া আত্মপ্রসাদ অনুভব করিতেছি। |