ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড, বারাকপুর’-এর একটি নোটিস ছাপা হয়েছে (২৮-৫)। বিষয় বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের ১৭টি স্থানের দুশো বছরের পুরনো নামগুলির বদলের ঘোষণা। এই বিষয়ে সমস্ত ইতিহাস-সচেতন মানুষের দরবারে কিছু তথ্য পেশ করতে চাই। অতীতকে মুছে ফেলার এই চেষ্টার প্রতিবাদ না-করলে, ভবিষ্যতের কাছে আমরা অপরাধী হয়ে থাকব।
১৭৫৭-য় পলাশির যুদ্ধ জয়ের পর ১৭৬০-এ রবার্ট ক্লাইভ ‘বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রি’ নামে এক সৈন্যদল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭৭৫ (মতান্তরে ১৭৭২) থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই ভারতীয় সৈন্যরা ব্রিটিশ ও অন্য ভাড়াটে সৈন্যদের সঙ্গে কলকাতা থেকে ১৫ মাইল উজানে চানক নামক জায়গাটির একটি অংশে গঙ্গার উত্তর তীরে, স্থায়ী ছাউনি (ক্যান্টনমেন্ট) বানিয়ে থাকা শুরু করে। ভারতের অন্যতম প্রাচীন ক্যান্টনমেন্ট বারাকপুরের শুরুটা হয়েছিল এ ভাবেই। ১৭৯৮-’৯৯ থেকে গভর্নর জেনারেল লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে বারাকপুরে গড়ে উঠতে থাকে ‘বারাকপুর গভর্নমেন্ট হাউস’, ভারতের গভর্নর জেনারেলের (বড়লাটের) সুরম্য বাগানবাড়ি, বিলিতি কায়দার বাগান, ‘বারাকপুর পার্ক’ আর তার সঙ্গে এক বিরাট চিড়িয়াখানা। উচ্চপদস্থ ইংরেজ রাজপুরুষরা বারাকপুরে নিয়মিত আসা-যাওয়া শুরু করেন। তখন জলপথই বেশি ব্যবহৃত হত। ১৮০৫-এর জুলাই মাসে শ্যামবাজার থেকে বারাকপুর পর্যন্ত ইট-বাঁধানো রাস্তা ‘গ্রেট ট্রাঙ্ক রোড’ (বর্তমানে বি টি রোড) খুলে দেওয়া হলে বারাকপুরের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। |
ভারতে ক্যান্টনমেন্ট ‘লে-আউট’ পরিকল্পনায় বারাকপুরের নকশাই পথিকৃৎ। বারাকপুরের প্রথম মানচিত্র ১৮৪১-এ চার্লস জোসেফের ম্যাপে এবং পরে ১৮৬৬-তে রেভিনিউ সার্ভে ম্যাপে এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। প্যারেড গ্রাউন্ডের অবস্থান ছিল ক্যান্টনমেন্টের কেন্দ্রে। নদীর ধারে পরিকল্পিত ভাবে সাজানো রিভারসাইড রোড, মিডল রোড ও পার্ক রোডের বাংলোগুলিতে সামরিক ও অসামরিক ইংরেজ অফিসাররা বাস করতেন। কাছাকাছি ছিল ব্রিটিশ সৈন্যদের ব্যারাক ও ইউরোপিয়ান হাসপাতাল।
ভারতীয় সেপাইদের থাকার ব্যবস্থা ছিল ক্যান্টনমেন্টের অন্য প্রান্তে ঘিঞ্জি ‘সেপাই লাইন্সে’ (বর্তমানে সেই জায়গাটি ভারতীয় বায়ুসেনার অধীন)। তাদের হাসপাতালও ছিল আলাদা। বারাকপুরে প্রায় ৪০০০ ভারতীয় সেপাই থাকতেন। এর মধ্যে পালা করে ১২০০ জন ফোর্ট উইলিয়ামে ডিউটি করতে যেতেন। ক্যান্টনমেন্টে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের জোগান দিতে বসানো হল বাজার এবং ক্যান্টনমেন্টে বিভিন্ন পরিষেবা দেওয়ার অসামরিক মানুষের জোগান দিতে বাজারের গায়ে গায়ে বসানো হল দেশি মানুষের বসবাসের অনেকগুলি নির্দিষ্ট ‘মহল্লা’। বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টের পশ্চিম প্রান্তে মূল বাজার ‘সদর বাজার’, পূর্ব প্রান্তে ‘সেপাই লাইনস’-এর কাছাকাছি নেটিভদের ‘আর্দালি বাজার’। এই বাজার ও মহল্লার মহলগুলি এক নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুযায়ী গড়ে তোলা হল। ঘনসংবদ্ধ রাস্তাগুলি সমান্তরাল সরলরেখায় বিস্তৃত। মোড়গুলিতে একে অপরকে সর্বদা ৯০ ডিগ্রি কোণে পার হয়েছে। বিভিন্ন মহলগুলিতে নির্দিষ্ট পেশা বা পণ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষের বাস করার ব্যবস্থা করা হল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মহলগুলির নামকরণ হল সেখানে বসবাসকারী মানুষের পেশা বা সেখানকার লভ্য পণ্যের নামে। যাতে করে যে কোনও পণ্য বা পরিষেবা চট করে খুঁজে পাওয়া যায়। বেঙ্গল নেটিভ ইনফ্যান্ট্রির সেপাইদের মতো এই মহলগুলিতেও ইংরেজরা হিন্দুস্থানি ও উর্দুভাষী মানুষদেরই অগ্রাধিকার দিয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টের সিভিল সাপোর্ট পপুলেশন হিসাবে বাঙালি অবশ্যই ছিলেন, তবে সংখ্যায় কম। আজও সেই মানুষদের বংশধররা ওই মহলগুলিতে বাস করছেন। কয়েকটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে আর্দালি বাজার, কুঁনজরা মহল (কুঁনজরা বিহারের মুসলমান ধর্মাবলম্বী অন্ত্যজ সম্প্রদায়, পেশা সবজি বিক্রয়, কায়িক শ্রম), মুরগি মহল, মুচি মহল, বেকার মহল, সবজি মহল, লকড়ি মহল, ছপ্পর মহল (ছপ্পর অর্থ ছাদ, পেশা ঘরামি), গোলা মহল (সম্ভাব্য পেশা গোলন্দাজ বাহিনীর ভারবাহী শ্রমিক), বাজাজ মহল, (পেশা দর্জি), মরিয়াম মহল (মরিয়াম, যিশুর মাতা মেরির আরবি নাম, সম্ভবত ভারতীয় ক্রিস্টানরা এই মহল্লায় বাস করতেন), আলিগোলি মহল, লুটেরি মহল, টিকিয়া মহল (আরবি টিকিয়া শব্দের অর্থ উপাসক, এখানে কি মসজিদ ছিল?)। সেই আমলের প্যারেড গ্রাউন্ডের সামনের রাস্তার নাম ‘প্যারেড রোড’। এ থেকে পুরনো প্যারেড গ্রাউন্ডের অবস্থান এখনও বোঝা যায়। পুরনো ইউরোপিয়ান হাসপাতাল ভবনের সামনের রাস্তার নাম ‘হাসপাতাল রোড’। দুশো বছর ধরে ব্যবহৃত এই নামগুলি কার কী অসুবিধা ঘটাল যে, সব পাল্টে ফেলতে হবে!
১৭৭৫ থেকে ব্যবহৃত এই ‘মহল’, ‘বাজার’ এবং রাস্তার নামগুলি বারাকপুরের ক্যান্টনমেন্ট ও স্থানীয় সামাজিক ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং আকর। এই বিষয়ে বহু অনুসন্ধান এখনও করা বাকি। আমার বিনীত আবেদন, আসুন আমরা একযোগে ইতিহাস মুছে ফেলার এই অজ্ঞতাকে ধিক্কার জানাই আর নামবদলের বিরুদ্ধে সরব হয়ে পুরনো নামগুলি বহাল রাখতে সচেষ্ট হই।
অমিতাভ কারকুন। বারাকপুর-১২০ |