পাকিস্তান সীমান্ত হইতে রসদ বোঝাই ট্রাকের কনভয় দীর্ঘ সাত মাস পর আবার আফগানিস্তানে মোতায়েন নেটো’র বহুজাতিক বাহিনীর জন্য পাড়ি দিবে। কয়েক মাস এই পথ বন্ধ ছিল, তাহার কারণ, গত নভেম্বর মাসে মার্কিন বিমানবাহিনীর এক অতর্কিত হানায় দুই ডজন পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষী নিহত হন। সমগ্র পাকিস্তানে এই ঘটনার তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহিত যাবতীয় সম্পর্ক চুকাইয়া ফেলার দাবিও ইসলামাবাদের রাজনৈতিক মহলে উঠিতে থাকে। জাতীয়তাবাদী আবেগের সহিত জেহাদি পাশ্চাত্য-বিরোধিতা মিশিয়া আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানকেই পাক সার্বভৌমত্বের উপর আক্রমণ রূপে শনাক্ত করা হইতে থাকে। তাহার প্রতিক্রিয়াতেই নেটো’র জন্য সীমান্তপথ বন্ধ করিয়া দেওয়া হয়। অতঃপর কূটনৈতিক ও অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক স্তরে দুই দেশের মধ্যে টানাপড়েন চলিতে থাকে। অবশেষে মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টন সাত মাস আগের মার্কিন হামলার জন্য আনুষ্ঠানিক ভাবে দুঃখপ্রকাশ করিয়াছেন। পথও খুলিতেছে।
ইহা নিঃসন্দেহে ইসলামাবাদের একটি রণকৌশলগত বিজয়। ইহার ফলে আই এস আই সহ পাক সামরিক বাহিনীর কর্তাদের অহমিকা যেমন তৃপ্ত করা গেল, তেমনই স্থগিত হইয়া যাওয়া অর্বুদ ডলারের মার্কিন অর্থসাহায্যও পুনরায় চালু করিবার পথ প্রশস্ত হইল। পাকিস্তান যে মার্কিন ঔদ্ধত্যের সম্মুখে মাথা নত করে নাই, উপরন্তু বৃহৎশক্তিকে কার্যত ক্ষমা চাহিতে বাধ্য করিয়াছে, ইহাতে লস্কর-এ-তইবার মতো জেহাদি পাক গোষ্ঠীর নেতাদেরও আপাতত তুষ্ট রাখা গেল। এটুকু না করিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও উপায় ছিল না। যে বিপুল পরিমাণ রসদ নেটো’র বহুজাতিক বাহিনীকে সরবরাহ করিতে হয়, তাহা রাশিয়া ও মধ্য এশিয়ার ভূতপূর্ব সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলির মধ্য দিয়া বিমানযোগে উড়াইয়া আনিতে কোটি কোটি মার্কিন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় হইতেছিল। আফগানিস্তান ছাড়িয়া স্বদেশে ফিরিয়া যাওয়ার নির্ঘণ্ট ঘোষিত হইয়া গিয়াছে, অথচ অন্তিম পর্বের তালিবান-বিরোধী যুদ্ধে রসদের অভাবে অপ্রস্তুত অবস্থায় বিদেশ-বিভুঁয়ে পড়িয়া থাকার মনোবল ধ্বংসকারী পরিস্থিতিতে অগণিত সেনা পড়িয়া থাকিবে, ইহা কাম্য নয়। হিলারি ক্লিন্টন তাই একপ্রকার বাধ্য হইয়াই ইসলামাবাদের দাবি মানিয়া লইয়াছেন। পাকিস্তানও অবশ্য তাহার ভূখণ্ড হইতে আফগানিস্তানে এই রসদ স্থানান্তরের জন্য কোনও কর আরোপ করিতেছে না, যাহা সে করিতেই পারিত।
নষ্ট মধুচন্দ্রিমা অতএব আবার নূতন করিয়া শুরু হইয়াছে। তবে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে আল-কায়দা জঙ্গি ও পাক তালিবানের জেহাদিদের খোঁজে দূরনিয়ন্ত্রিত মার্কিন ড্রোন-বিমানের ক্ষেপণাস্ত্র হানার বিষয়টি অতঃপর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নূতন কাঁটা হইয়া উঠিতে পারে। এক বার রক্তের স্বাদ পাওয়া ইসলামাবাদ এ বার আকাশপথে এই আক্রমণের প্রতিবাদকেও উচ্চতর গ্রামে তুলিতে পারে এবং ড্রোন-হানা বন্ধ করিতে ওয়াশিংটনের উপর চাপ সৃষ্টি করিতে পারে। পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হওয়ার প্রশ্নটি তো বহু কাল ধরিয়াই সরকারি ও বেসরকারি পাক গণমাধ্যমে আলোচিত হইতেছে। সেই বিতর্কে যে তালিবান, লস্কর ও অন্যান্য মৌলবাদী জেহাদি গোষ্ঠী পূর্ণ মাত্রায় মদত দিতেছে, তাহাও সুবিদিত। জেহাদি জঙ্গিদের সহিত পাক ক্ষমতাসীনদের আপস ও বোঝাপড়ার ঘটনাটি কাহারও অজানা নয়। এই অবস্থায় মার্কিন রণনৈতিক স্বার্থ এবং পাকিস্তানের সামরিক-রাজনৈতিক স্বার্থের মধ্যে ক্রমশ যে সংঘাত দেখা দিতেছে, ভবিষ্যতে তাহার সন্তোষজনক মীমাংসা করিয়া ওঠা দুরূহ হইতে পারে। পাকিস্তানের তালিবান গোষ্ঠীগুলি যে ভাবে নেটো’র পথ খুলিয়া দেওয়ার প্রতিবাদে সঙ্ঘবদ্ধ ও সরব হইতেছে, তাহাও নিশ্চয়ই ইসলামাবাদ এবং রাওয়ালপিন্ডির দুশ্চিন্তার কারণ। ওয়াশিংটনেরও। |