কুতব মিনার তো অনেক খাটো, আস্ত একটা আইফেল টাওয়ারও মাথা তুলে ছুঁতে পারবে না ভূস্বর্গের এই সেতুকে। চন্দ্রভাগার আকাশ ছুঁয়ে এমনই এক সেতু গড়ার কাজ শুরু হয়েছিল ৯ বছর আগে। কথা ছিল বিশ্বের সব থেকে উঁচুতে এই সেতু গড়ার কাজ শেষ করা হবে পাঁচ বছরের মধ্যেই। হয়নি। সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ার পরেও জম্মু-শ্রীনগর রেল প্রকল্পের কাজ যে ভাবে থমকে থমকে এগোচ্ছে তাতে কত দিনে যে সেতুটির কাজ শেষ হবে, তা নিয়ে ধন্দে প্রকল্পের কর্তারাই। অভিযোগ উঠছে, রেল মন্ত্রকের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই ৩৫৯ মিটার উঁচু রেল সেতু গড়ার কৃতিত্ব এখনও অধরা হয়ে রয়েছে ভারতের।
জম্মু-কাশ্মীরের রিয়াসি জেলায় ওই সেতুর জন্য দু’পাশের পাহাড়ে স্তম্ভ তৈরির কাজ এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু মাঝে যে ‘আর্চ’-টি রেলের লাইনকে নীচ থেকে ধরে রাখবে তার নকশাই চূড়ান্ত হয়নি এখনও। সেতুটি তৈরির দায়িত্ব কোঙ্কন রেলের হাতে থাকলেও সার্বিক ভাবে জম্মু-শ্রীনগর ৩৪৩ কিলোমিটার রেলপথ তৈরির প্রকল্পটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে উত্তর রেল। অভিযোগ উঠেছে, তদারকির চেয়ে দৈনন্দিন কাজেই বেশি হস্তক্ষেপ করছে তারা। ‘চেনাব ব্রিজ’-এর চূড়ান্ত নকশা মঞ্জুর করার ক্ষেত্রেও গড়িমসির অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। রেল মন্ত্রকের কোপে পড়ার আশঙ্কায় বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি কোঙ্কন কর্তৃপক্ষ। |
এ ভাবেই থমকে সেতুর কাজ। —নিজস্ব চিত্র |
কিন্তু নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত অফিসারদের অভিযোগ, কাজ এগিয়ে যাওয়ার পরে এখন মূল আর্চের নকশা নিয়ে অহেতুক প্রশ্ন তুলছে উত্তর রেল। নকশা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত কাজ আর এগোতে পারছে না। উত্তর রেল অবশ্য এই অভিযোগ মানতে চায়নি। তাদের কথায়, “কোঙ্কন রেলের কাজে কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ায় গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।” চূড়ান্ত নকশা দ্রুত মঞ্জুর করা হবে বলেও জানিয়েছে উত্তর রেল। এই চাপানউতোরের জটে উচ্চতম রেলসেতুর স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে গিয়ে এখন ঘোর সমস্যায় রেল মন্ত্রক। আপাতত ঠিক হয়েছে, কাজ শেষ করা হবে ২০১৭-র মধ্যে। কিন্তু সেটাও সম্ভব হবে কি না, সংশয় রয়েছে রেল মন্ত্রকেই। একই প্রশ্ন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়েও।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী এই পরিকল্পনার জন্ম গত শতকের শেষ দশকে। ২০০৩-এ একে জাতীয় প্রকল্প ঘোষণা করে তৎকালীন এনডিএ সরকার। কাশ্মীরকে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করার পাশাপাশি প্রতিরক্ষার দিক থেকেও অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ এই রেলপথ তৈরির দায়িত্ব ভাগ করা হয়েছে উত্তর রেল, ইরকন ও কোঙ্কন রেলের উপর। উধমপুর থেকে কাটরা পর্যন্ত উত্তর রেল। ধরম থেকে কাটরা এই ৭০ কিলোমিটার লাইন পাতার দায়িত্ব কোঙ্কন রেলের। কিছু সুড়ঙ্গ তৈরির দায়িত্ব ছাড়াও ইরকনের দায়িত্ব মূলত লাইন পাতার। কোঙ্কন রেলের অফিসার সঞ্জীব মজুমদার জানালেন, “সব থেকে কঠিন অংশ রূপায়ণের দায়িত্ব পড়েছে আমাদের উপর। এই অংশে বানাতে হবে ১৮টি সুড়ঙ্গ ও ২৬ সেতু।” যার সব চেয়ে বড়টি হচ্ছে রিয়াসিতে।
দৈর্ঘে ১৩১৫ মিটার। আহামরি কিছু নয়। কিন্তু কাজটা ময়দানবীয়। খাড়া পাহাড়। সড়কপথের নামগন্ধ নেই। পাহাড় ফাটিয়ে প্রথমে তৈরি করা হয়েছিল হেলিপ্যাড। সেনা-হেলিকপ্টার সেখানে পৌঁছে দেয় দৈত্যাকার যন্ত্রপাতি। প্রায় শূন্যে ঝুলে, প্রকৃতির রোষের বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চিপে স্তম্ভ বসানোর কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে কোঙ্কন রেল। সেতুটি জোড়ার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। জঙ্গি সমস্যা সামলে পাহাড়ের দু’প্রান্তে ১২৭ মিটার উঁচু লোহার পিলিয়ন বসে গিয়েছে। সেতু নির্মাণের দায়িত্বে থাকা ডি কে কোনার জানান, “মোট ২৫ হাজার টন ইস্পাত লাগবে সেতুটিতে। বিস্ফোরণের ধাক্কাও সামলাতে পারবে। আয়ু ধরা হয়েছে ১২০ বছর। সাধারণত রেল-সেতু রং করা হয় ১০ বছর অন্তর। দুর্গম এলাকা বলে এখানে এমন রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে প্রতি ৩৫ বছর পরে রং করার দরকার হয়।” নির্মাণস্থলের ঠিক পিছনেই ওয়ার্কশপ। কোঙ্কন রেলের অধিকর্তা (প্রজেক্টস) রাজেশ অগ্রবাল বললেন, “সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয় কাজ এখানেই হচ্ছে। পরে বিশাল ক্রেনে তা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে নির্মাণস্থলে।”
সেতু ও রেলপথ নির্মাণের কাজে মালপত্র নিয়ে যেতে প্রায় ১৬৬ কিলোমিটার রাস্তা বানিয়েছে কোঙ্কন রেল। সেই রাস্তাই পরিবর্তন আনছে এলাকার আর্থ-সামাজিক জীবনে। স্বাধীনতার ছয় দশকে মোটরবাইকও দেখেনি যে গ্রাম, তারই দোরগোড়ায় এখন বাস আসে। ফলে যোগাযোগ বেড়েছে মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে। নতুন রেলপথের পাশাপাশি এই পরিবর্তনই বাড়তি পাওনা জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের কাছে। |