কলকাতা বিমানবন্দরে ওড়ার অপেক্ষায় লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পাঁচ-পাঁচটি বিমান। যাত্রীরা বসে আছেন ভিতরে। ঠিক ছিল, প্রথম ও দ্বিতীয় বিমানের নেমে আসার মাঝখানে যেটুকু সময় পাওয়া যাবে, তখনই একটি বিমানকে উড়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যাবে।
কিন্তু এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি)-এর অফিসারের সেই পরিকল্পনা বানচাল করে দিয়ে দ্বিতীয় বিমান নেমে এল হুহু করে। অথচ এটিসি থেকে ওই দ্বিতীয় বিমানের পাইলটের কাছে নির্দেশ গিয়েছিল, “গতি কমিয়ে নামুন।” কিন্তু পাইলট সেই নির্দেশ না-মেনে নেমে এলেন দ্রুত। প্রথমে নামা বিমানটি তখন সবে রানওয়ে খালি করে গড়িয়ে গিয়েছে নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়ানোর জন্য। আর দু’টি বিমানের অবতরণের মধ্যে যে-বিমানের ওড়ার কথা ছিল, সেটি তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে।
কলকাতায় এই সমস্যা নিত্যদিনের। এতে সময় নিয়ে টানাটানি তো হচ্ছেই। তার থেকেও বড় কথা, মাটিতে থেকে যারা বিমানের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে, সেই এটিসি-র পরিকল্পনা ও নির্দেশ বেমালুম উপেক্ষা করছেন পাইলট। নামার ক্ষেত্রে অনেক পাইলট যেমন তাড়াহুড়ো করছেন, উড়ে যাওয়ার অনুমতি পেয়ে রানওয়েতে গিয়েও অনেক ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সময় দাঁড়িয়ে থাকছে বিমান। অথচ বিমানটি তাড়াতাড়ি উড়ে গেলে আকাশে অপেক্ষমাণ বিমানকে দ্রুত নামিয়ে আনা সম্ভব। উড়তে গিয়ে পাইলট বেশি সময় নেওয়ায় নামার পথে দেরি হয়ে যাচ্ছে অন্য বিমানের।
তাঁরা প্রায় প্রতিদিনই এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন বলে এটিসি অফিসারদের অভিযোগ। যাঁরা কলকাতায় এটিসি-তে কাজ করছেন, তাঁদের প্রায় ৭০ শতাংশ অফিসারই কমবয়সী। পাঁচ বছর বা তারও কম সময় ধরে কাজ করছেন তাঁরা। এই ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে এখনও দক্ষ হয়ে ওঠেননি। প্রধানত এই সব জুনিয়র অফিসারকে নিয়ে দু’দিনের আলোচনাচক্রের আয়োজন করেছিলেন কলকাতা বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। ছবি, স্লাইডের সাহায্যে সমস্যার বিভিন্ন দিক ব্যাখ্যা করে বোঝানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল জুনিয়র অফিসারদেরই। কর্তৃপক্ষের রিজিওনাল এগ্জিকিউটিভ ডিরেক্টর মনোহরলাল লাকড়া বলেন, ‘‘বই পড়ে বা কাজের মধ্য দিয়ে এই জুনিয়র অফিসারেরা তো শিখছেনই। সেই সঙ্গে এই ধরনের আলোচনাচক্রের মাধ্যমে তাঁরা আরও অনেক কিছু শিখতে পারছেন।”
সমস্যার বড় জায়গা জুড়ে আছে ব্যক্তিত্বের সংঘাতও। এক জুনিয়র অফিসারের কথায়, “পাইলটদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, তাঁরা যেন নিজেদের উচ্চ শ্রেণির মানুষ মনে করেন। আর আমরা নিম্ন শ্রেণির। এতে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে।” এটিসি অফিসারদের অভিযোগ, অনেক সময়েই পাইলটদের ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রশ্নের জন্য সময়ের অপচয় হচ্ছে। উদাহরণ দিয়ে বলা হয়েছে, নামার সময়ে পরপর ‘লাইন’-এ থাকতে হয় বিভিন্ন বিমানকে। পাইলটকে জানিয়ে দেওয়া হয়, তিনি লাইনে কত নম্বরে রয়েছেন। অনেক ক্ষেত্রেই চার বা পাঁচ নম্বরে থাকা পাইলট প্রশ্ন করেন, “আমার আগে কোন কোন বিমান রয়েছে?” এটিসি অফিসার বলেন, “এটি জেনে পাইলটের কোনও লাভ নেই। আমাকে সেই মুহূর্তে যদি ওই পাইলটকে তালিকার ফিরিস্তি দিতে হয়, অনেকটা সময় নষ্ট হয়ে যাবে। সেই সমটায় আমি অন্য পাইলটের সঙ্গে জরুরি কথা বলতে পারব।”
লাকড়া জানিয়েছেন, পাইলটদের সঙ্গে এটিসি অফিসারদের এই সমস্যা দীর্ঘদিনের। তাই এ বার থেকে পাইলট এবং এটিসি অফিসারদের একসঙ্গে নিয়ে আলোচনাচক্রের আয়োজন করারও ব্যবস্থা হচ্ছে। সমস্যার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন বহু দিনের পাইলট এবং এয়ারলাইন্স অপারেটিং কমিটির চেয়ারম্যান সর্বেশ গুপ্তও। তিনি বলেন, “মাঝেমধ্যেই এই ধরনের সমস্যা হচ্ছে। মিখোমুখি আলোচনায় সমাধানের পথ মিলবে বলেই আশা করছি।” |