বালিগঞ্জ স্টেশন ছেড়ে সবে পার্ক সার্কাসের দিকে রওনা হয়েছিল শিয়ালদহমুখী বজবজ লোকাল। হঠাৎই বিকট শব্দ এবং দু’টি কামরা বেলাইন। ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ট্রেনটি। রবিবার দুপুরের এই দুর্ঘটনায় হতাহতের খবর নেই। কিন্তু এর জেরে বিপর্যস্ত হয়ে যায় শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার ট্রেন চলাচল। সেই সঙ্গে ফের উঠে এসেছে রেলের রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির প্রশ্নটিও।
১২ কামরার ট্রেন চালানোর জন্য এ দিন সকাল থেকে দমদম জংশন স্টেশনে লাইনের পয়েন্ট বদল এবং রেললাইনের নকশা পাল্টানোর কাজ চলে। সেই কাজের জন্য শিয়ালদহ উত্তর শাখায় ১৪৭টি ট্রেন বাতিল করা হয়।
দক্ষিণে বালিগঞ্জের দুর্ঘটনা আর উত্তরে দমদমে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। দুইয়ে মিলিয়ে এ দিন যাত্রীদের দুর্ভোগ চরমে ওঠে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রেন না-পেয়ে রেললাইন ধরে হাঁটতে শুরু করেন অনেকে। পূর্ব রেল জানায়, এ দিন রাত সাড়ে ৭টার মধ্যে দক্ষিণ শাখায় মেরামতির কাজ শেষ হয়ে গিয়েছে। আর শিয়ালদহ উত্তর শাখায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়ে যাবে আজ, সোমবার ভোর থেকেই। |
বালিগঞ্জ স্টেশনে বেলাইন বজবজ লোকালের দু’টি কামরা। রবিবার। ছবি: দেবাশিস রায় |
কী হয়েছিল এ দিন বালিগঞ্জে?
রেল জানায়, বেলা ১২টা ১০ মিনিটে বজবজ লোকালটি বালিগঞ্জ স্টেশনের তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরোনোর কিছু পরেই ট্রেনের পিছনের দিকের মহিলা কামরা-সহ দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হয়ে যায়। কামরা দু’টি লাইনচ্যুত হয়ে ধাক্কা মারে পাশের একটি বিদ্যুতের খুঁটিতে। ওভারহেড তার ছিঁড়ে যাওয়ায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় বিদ্যুৎ-সংযোগ ব্যবস্থা। সওয়া ১২টা থেকে পুরো শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখায় ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। পরপর দাঁড়িয়ে যায় কয়েকটি ট্রেন।
ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ১২ কামরার ট্রেনটির ১০ এবং ১১ নম্বর কামরা দু’টি লাইন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। লাইনের পাশে পড়ে আছে ব্রেকের ‘এয়ার ট্যাঙ্ক’। গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছে রেল পুলিশ এবং রেল সুরক্ষা বাহিনী। চার দিকে ভিড়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হঠাৎই বিকট শব্দ পান তাঁরা। এসে দেখেন, ট্রেনের দু’টি কামরা লাইন ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছে। মহিলা কামরার যাত্রীরা রীতিমতো আতঙ্কিত। ওই যাত্রীদের কামরা থেকে নামিয়ে আনেন তাঁরাই। ট্রেন আটকে পড়ায় বহু যাত্রী বাস বা ট্যাক্সিতে গন্তব্যে পাড়ি দেন। মওকা বুঝে কসবার বিজন সেতু আর শিয়ালদহ চত্বর থেকে যেমন খুশি ভাড়া হেঁকেছেন ট্যাক্সি এবং অটোচালকেরা।
রেল সূত্রের খবর, ছুটির দিন হওয়ায় যাত্রী কম ছিল। স্টেশনের কাছে গতিও কম ছিল ট্রেনের। তাই দু’টি কামরা লাইনচ্যুত হলেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো গিয়েছে। ঘটনাস্থলে যান পূর্ব রেলের জেনারেল ম্যানেজার জি সি অগ্রবাল, শিয়ালদহের ডিআরএম সুচিত্তকুমার দাস-সহ রেলের পদস্থ কর্তারা। আসে রেলের ‘রিলিফ ভ্যান’ বা দুর্ঘটনা মোকাবিলা ভ্যানও। রেল বলছে, দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই শিয়ালদহ থেকে ‘রিলিফ ভ্যান’ রওনা দিয়েছিল। তবে পরপর দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনগুলির জন্য সেটির পৌঁছতে দেরি হয়। দুপুরে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে অগ্রবাল বলেন, “কেন এমনটা হল, তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। আপাতত সোনারপুর এবং নিউ আলিপুর থেকে ট্রেন চালানো হবে। শিয়ালদহ থেকে ট্রেন বন্ধ থাকার জন্য রাজ্য সরকারকে বিশেষ বাস চালাতে অনুরোধ করা হয়েছে।” বিকেলে পূর্ব রেল বিবৃতি দিয়ে জানায়, বালিগঞ্জ থেকে দক্ষিণ শাখার বিভিন্ন দিকে ফের ট্রেন চলাচল শুরু হয়েছে। |
ট্রেন চলাচল ব্যাহত শিয়ালদহ উত্তর শাখায়। রবিবার এ ভাবেই লাইন
ধরে হাঁটতে হল যাত্রীদের। দমদম স্টেশন সংলগ্ন অঞ্চলে। —নিজস্ব চিত্র। |
দুর্ঘটনা ঘটল কী ভাবে?
ট্রেন বেলাইন হওয়ার কারণ সম্পর্কে রেলকর্তারা সরাসরি কিছু জানাতে চাননি। তবে প্রাথমিক তদন্তে মূলত দু’টি কারণের কথা উঠে এসেছে বলে রেল সূত্রের খবর। এক রেলকর্তা জানান, পয়েন্টে গোলমাল অথবা আচমকা চাকা আটকে যাওয়ার ফলেই দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে পয়েন্টের গণ্ডগোল হলে ট্রেনের বেশির ভাগ অংশ কী ভাবে নিরাপদে বেরিয়ে গেল, সেটাও ভাবাচ্ছে।
চাকা আটকে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে এখনও নিশ্চিত নন রেলকর্তারা। রেলের খবর, এ দিন দুর্ঘটনার পরেই ‘এয়ার ট্যাঙ্ক’ খুলে বেরিয়ে গিয়েছিল। রেল নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, চলতে চলতে আচমকা চাকা বন্ধ হয়ে গেলে এমন বিপত্তি ঘটতে পারে। রেলওয়ে সেফটি কমিশনার আলাদা ভাবে তদন্ত করছেন। তিনি রিপোর্ট দেওয়ার পরেই বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। লাইনচ্যুত হওয়ার ফলে চাকার ধাক্কায় রেললাইন সরে গিয়ে প্যান্ড্রোল ক্লিপ খুলে গিয়েছিল।
পয়েন্টের গোলমাল বা আচমকা চাকা আটকে যাওয়া দুর্ঘটনার কারণ যা-ই হোক, রক্ষণাবেক্ষণে গাফিলতির প্রশ্নটি উঠছেই। কয়েক বছর ধরে পরপর ছোট-বড় ট্রেন দুর্ঘটনার জন্য রক্ষণাবেক্ষণের ত্রুটিকেই দায়ী করেছেন রেলকর্তাদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, দূরপাল্লা বা লোকাল ট্রেন বারবার লাইনচ্যুত হচ্ছে। চাকা আটকে যাচ্ছে। চাকার ব্রেক আটকে আগুনের ফুলকি বেরোচ্ছে। প্যান্টোগ্রাফ ভেঙে পড়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। অথচ রেলের উচ্চপদস্থ কর্তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই।
এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে কেন?
রেলের একাংশের বক্তব্য, টাকার অভাবে নতুন কামরা কেনা যাচ্ছে না। পুরনো কামরাগুলিকেই মেরামত করে চালানো হচ্ছে। তার উপরে নিত্যনতুন ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর ফলে কারশেডে রেকগুলি বিশ্রাম পাচ্ছে না। যথাযথ ভাবে করা যাচ্ছে না রক্ষণাবেক্ষণের কাজও।
দক্ষিণে দুর্ভোগের কারণ বালিগঞ্জের দুর্ঘটনা। শিয়ালদহ উত্তরে প্রচুর ট্রেন বন্ধ থাকবে বলে রেল অবশ্য আগেই জানিয়েছিল। রবিবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে দমদম জংশন স্টেশনে কাছে লাইনের পয়েন্ট পাল্টানো এবং রেললাইনের নকশা বদলানোর কথা ছিল। রেল বলেছিল, ওই কাজের জন্য দমদম স্টেশনে ‘ব্লক’ (রেলের মেরামতি বা সংস্কারের কাজের জন্য লাইন বন্ধ রাখা) নেওয়া হয়েছে। রবিবার চার ও পাঁচ নম্বর প্ল্যাটফর্ম বন্ধ থাকবে। বাতিল করা হবে ১৪৭টি ট্রেন। সেই কারণে এ দিন বনগাঁ, ডানকুনি এবং মেন লাইনের যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যাত্রীরা জানান, রবিবার এমনিতেই অনেক ট্রেন বাতিল থাকে। তার উপরে আরও ট্রেন বাতিল করায় ট্রেন মিলেছে এক থেকে দেড় ঘণ্টা অন্তর। ফলে তাতে এমনই ভিড় হয় যে, মাঝপথে ওঠা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেকেই ঝুঁকি নিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে যাতায়াত করেন। প্ল্যাটফর্মগুলিতেও থিকথিকে ভিড় ছিল দিনভর। ভোগান্তি বেশি হয়েছে মেট্রো থেকে নেমে শহরতলির ট্রেন ধরতে যাওয়া যাত্রীদের। |