সময়মতো রক্ত কিংবা অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করা গেলে হয়তো মৃত্যু আটকানো যেত হাসনাবাদের রামেশ্বরপুর গ্রামের জাহানারা বিবির. জেলা স্বাস্থ্য দফতর এবং পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্টে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
জাহানারা বিবি নামে এক প্রসূতির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে মঙ্গলবার তুলকালাম কাণ্ড ঘটে বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালে। চিকিৎসার গাফিলতিতে মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ করে রোগীর বাড়ির লোকজন মারধর করেন হাসপাতালের দু’জন নার্সকে। ভাঙচুর করা হয় চিকিৎসার সরঞ্জাম। সাংবাদিকদেরও নিগ্রহ করা হয় বলে অভিযোগ। যদিও সুপার সুব্রত মণ্ডলের বক্তব্য ছিল, “রোগিণীর চিকিৎসায় কোনও গাফিলতি ছিল না। রোগী অসুস্থ হওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসককে ডেকে পাঠানো হয়। তিনি রোগীকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। তা সত্ত্বেও দু’জন নার্সকে মারধর করা হয়।” এর পরে কেন রোগীর মৃত্যু হল? হাসপাতালে ভাঙচুর, মারধরের ঘটনা ঘটল, সে ব্যাপারে জেলা স্বাস্থ্য দফতর থেকে সুপার সুব্রতবাবুর কাছে রিপোর্ট চেয়ে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি গোটা ঘটনা মুখ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে লিখিতভাবে জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য দাবি জানানো হবে বলে জানিয়েছেন বসিরহাট দক্ষিণ বিধানসবা কেন্দ্রের সিপিএম বিধায়ক নারায়ণ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “গত মঙ্গলবার হাসপাতালে সংবাদ সংগ্রহের জন্য যাওয়া সাংবাদিকদের যারা হেনস্থা করেছে, যারা নার্সদের মারধর করেছে অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশকে বলা হয়েছে।” হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক যাতে দিনরাত খোলা থাকে এবং সুপার যাতে হাসপাতালে সর্বক্ষণ থাকেন সে ব্যাপারেও মুখ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে দাবি জানানো হবে বলে জানান নারায়ণবাবু।
প্রসঙ্গত, বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক সর্বক্ষণ খোলা রাখার ব্যবস্থা নেই। হাসপাতালের সুপার সপ্তাহে তিন চারদিনের বেশি আসেন না। এলেও হাসপাতালে কিছুক্ষণ থেকে নিজের চেম্বার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আসা রোগীদের। স্থানীয় তৃণমূল নেতা বাদল মিত্র বলেন, “সুপারকে যে সব সময় হাসপাতালে পাওয়া যায় না এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অভিযোগ রয়েছে।” কংগ্রেস নেতা অসিত পাত্র বলেন, “ঘটনার দিন সুপারের ঔদ্ধত্যর্পূণ আচরণের জন্য গণ্ডগোল আরও বাড়ে।”
স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালকে জেলা হাসপাতাল হিসাবে ঘোষণা করা সত্ত্বেও বিকেলের পর জরুরি পরিষেবা হিসাবে ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলা রাখা হয় না। বেশিরভাগ সময়েই মেলে না হাসপাতালের অ্যাম্বুল্যান্স। জরুরি প্রয়োজনে বারাসত বা কলকাতা থেকে রোগীর জন্য রক্ত আনার ব্যবস্থা করতে হয় রোগীর বাড়ির লোকজনকে। অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় অনেক বেশি ভাড়া গুণে অন্য গাড়িতে করে রোগীকে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। অনেক ক্ষেত্রেই গরিব রোগীদের পরিবারের ওই টাকা খরচের সামর্থ্য থাকে না। সে ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটে। জাহানারা বিবির ক্ষেত্রেও এমনটাই ঘটেছিল বলে তাঁর বাড়ির লোকের বক্তব্য। তাঁদের অভিযোগ, অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের কারণে সোমবার রাত দেড়টা নাগাদ যখন তাঁর রক্তের প্রয়োজন হয়ে পড়ে তখন হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্ক বন্ধ ছিল। রোগীকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য পাওয়া যায়নি অ্যাম্বুল্যান্স। অন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে গেলে রোগীর বাড়ির লোকজনদের কাছে চোদ্দোশো-পনেরোশো টাকা চাওয়া হয়। যা দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না জাহানারা বিবির স্বামীর।
উত্তর ২৪ পরগনা জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুশান্ত শীল বলেন, “সুপারের কাছে প্রাথমিক রিপোর্ট চাওয়া হয়েছে। রিপোর্ট পেলে গোটা ঘটনার তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” হাসপাতালের পরিকাঠামোগত সমস্যা নিয়ে সুশান্তবাবু বলেন, “একজন টেকনিশিয়ানের অভাবে বসিরহাট মহকুমা হাসপাতালে রাতে ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলা রাখা যাচ্ছে না। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে।” হাসপাতালে সুপারের সব সময় না থাকার অভিযোগ নিয়ে সুপার সুব্রত মণ্ডল বলেন, “আমার অনুপস্থিতিতে এখন থেকে এক জন চিকিৎসক সুপারের দায়িত্বে থাকবেন। ঘটনার দিন দু’টি অ্যাম্বুল্যান্স ছিল। তবে কর্মীর অভাবেই দিনরাত ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলা রাখা সম্ভব হচ্ছে না।”
পুলিশ জানিয়েছে, গত মঙ্গলবারের ঘটনায় সাংবাদিক নিগ্রহে জড়িতদের শনাক্ত করা গিয়েছে। শীঘ্রই তাদের গ্রেফতার করা হবে। মঙ্গলবারের ঘটনার প্রেক্ষিতে চিকিৎসক, নার্সদের নিরাপত্তায় হাসপাতালে পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে। |