শিলে পেষা বাটনার বদলে প্যাকেটবন্দি রেডিমেড মশলা। সকাল-সন্ধে রান্নার ঝক্কির বদলে চটজলদি ফুটিয়ে নেওয়া রেডি-টু-ইট খাদ্য। একেলে নিউক্লিয়ার পরিবারের ব্যস্ত জীবনে এমন ‘শর্ট-কাট’ রান্নাই এখন দস্তুর।
হেঁশেলের এই মুশকিল-আসান নিয়েই কিন্তু প্রশ্নের শেষ নেই।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনলজি-র শিক্ষক উৎপল রায়চৌধুরীর কথায়, “এই সব তৈরি খাবার বা রকমারি মশলা-বাটার প্যাকেটে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষতিকারক প্রিজারভেটিভ বা নিষিদ্ধ রং ব্যবহারের নমুনা মিলেছে। অথচ, কে কতটা প্রিজারভেটিভ বা রং ব্যবহার করছে তা কেউ বলে না। এ ব্যাপারে নজরদারির আইন থাকলেও তা প্রয়োগের সচেতনতা কম।” পুষ্টিবিদ রেশমি রায়চৌধুরীও বলছেন, “প্রক্রিয়াকরণের জেরে খাদ্যগুণের দফারফা হচ্ছে। প্রিজারভেটিভ বা রং মেশানো খাবার খেয়েই ইদানীং সাত তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। ক্যানসারেরও আশঙ্কা থাকছে।” প্যাকেটজাত খাবার প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির তরফে সহনীয় মাত্রায় এই প্রিজারভেটিভ ব্যবহার করা হয় এবং তাতে বিপদের আশঙ্কা প্রায় থাকেই না বলে দাবি করা হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, খাবারের আয়ু বাড়াতেই পাল্লা দিয়ে বাড়ানো হয় প্রিজারভেটিভের মাত্রা।
অথচ কেন্দ্রীয় খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ বিভাগের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত এক দশকে সহজে রান্নার খাদ্যপণ্য বা কনভিনিয়েন্স ফুডের বাজারটা শতকরা ৭০ ভাগ বেড়েছে। ২০০৪-০৫ সালেই এই প্যাকেট খাদ্যের ব্যবসা এ দেশে ৮২৯০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ফি-বছর তা বাড়ছে ২০ শতাংশ হারে। কেন? সদ্যপ্রয়াত বিপণন বিশেষজ্ঞ শিলু চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেছিলেন, “স্বাচ্ছন্দ্য বা কনভিনিয়েন্সটাই এখন শেষ কথা।” এবং বহু ক্ষেত্রেই এই প্রিজারভেটিভের বিপদ নিয়ে লোকে যথেষ্ট সচেতন নয়। |
এই স্বাচ্ছন্দ্যের কাছে ‘আত্মসমর্পণ’টা অবশ্য কারও কারও এখনও না-পসন্দ। পুরনো গিন্নিদের অনেকেরই মনে পড়ে সে-কালের বাটনা-বাটার বিশেষ পর্ব। পরের দিন সকালে শিলে বাটা হবে বলে হলুদও রাতে ভিজিয়ে রাখতে হত। কোনও কোনও প্যাকেটের মশলা-বাটায় কীসের একটা গন্ধও সবার পছন্দ হয় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ‘উৎকট’ গন্ধের উৎসটাও প্রিজারভেটিভ। এক বছর বা ছ’মাস ধরে প্যাকেটের বাটনা বা খাদ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় প্রিজারভেটিভের মাত্রাও অনেকে বাড়িয়ে দেন। তাতে শরীরের ক্ষতিও বেশি। প্রিজারভেটিভের মাত্রা কম রেখে খাদ্যগুণ ও স্বাদ বজায় রাখাটা তবে কত দূর সম্ভব?
রাজ্যে আনকোরা প্যাকেট-বন্দি কাঁচা লঙ্কার বাটা নিয়ে হাজির একটি সংস্থা এ বার এই চেষ্টায় নেমেছে। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েই এগোচ্ছে তারা। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স-এর অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী শাশ্বতী লাহিড়ীর দাবি, “বিস্তর খেটেখুটে যৎসামান্য প্রিজারভেটিভ দিয়েই ওই সংস্থা আদাবাটা, কাঁচা লঙ্কাবাটা ও রসুনবাটা বানাচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে একেবারে প্রিজারভেটিভমুক্ত কাঁচা লঙ্কাবাটাও ওরা বাজারে আনতে চায়। তাতে স্বাদটা আরও খুলবে।” গেরস্তের ব্যবহারের উপযোগী ছোট পাউচ ও শিশিতে মিলছে এই বাটা। যাদবপুরের ফুড টেকনলজি বিভাগেও প্রিজারভেটিভের মাত্রা সহনীয় রেখে মশলা বা অন্য খাদ্যপণ্য তৈরির তালিম দেওয়া হচ্ছে।
কলকাতার একটি নামী রেস্তোরাঁ-গোষ্ঠীর কর্পোরেট শেফ চিরঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় নিজেই রকমারি দেশি-বিদেশি মশলা মিশিয়ে প্যাকেট-বন্দি ‘স্পাইস-রাব’ সৃষ্টি করছেন। তাঁরও দাবি, পাঁচ-সাত দিনের ‘শেল্ফ-লাইফ’-এর এই মশলায় কোনও প্রিজারভেটিভ নেই। ধনে-জিরের সঙ্গে মেক্সিকান লঙ্কাগুঁড়োর সঙ্গত বা গরম মশলার সঙ্গে ভিনদেশী হার্বের এই মিশেলে যে কোনও ঘরোয়া আমিষ-নিরামিষ রান্নাই জমবে। ইউরোপীয় খাদ্য-বিপণির আদলে তৈরি সল্টলেকের একটি ‘ডেলি শপে’ এখন ছোট ছোট প্যাকেটে বিকোচ্ছে নানা স্বাদ-রসায়নের এই মশলা।
রকমারি দেশি রান্নার প্যাকেট-গ্রেভি সৃষ্টিতে হাত পাকাতে এ দেশে বেঙ্গালুরুতে কারখানা খুলে ঘাঁটি গেড়েছে একটি মার্কিন বহুজাতিক সংস্থা। কিছু উপকরণযোগে ওই গ্রেভিতেই নানা পদ সহজে রান্না করা যাবে। সংস্থার ফুড সায়েন্টিস্ট সুনীতা রানার দাবি, “সহনীয় মাত্রায় ফুডগ্রেড প্রিজারভেটিভ দিয়েও এই ধরনের গ্রেভি তৈরি সম্ভব।”
বাজার-চলতি কয়েকটি দেশি ব্র্যান্ডের বাটনাতেও খাঁটি স্বাদ-গন্ধটা কিন্তু ফিরে আসছে বলে মনে করেন শহরের পরিচিত শেফ তথা রেস্তোরাঁ-কর্ণধার জয়মাল্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘শিলে সর্ষে বাটতে গিয়ে তেতো হওয়ার ট্র্যাজেডিও ভুরি ভুরি ঘটেছে। প্যাকেটের পেস্টে সে ঝুঁকি নেই।” সমকালীন বাঙালি রান্না নিয়ে নিরীক্ষায় মশগুল জয়মাল্য ভবিষ্যতে ‘রেডি-টু-ইট’ খানা নিয়ে কাজে আগ্রহী।
কিন্তু প্রিজারভেটিভের অনুপ্রবেশ ঠেকানো নিয়ে কী ভাবছেন তিনি?
জয়মাল্যের কথায়, “কিছুটা খরচার ব্যাপার হলেও খাবার জিইয়ে রাখার অনেক প্রযুক্তি এখন হাতের মুঠোয়। রিটর্ট পাউচিং-এর মতো কিছু কৌশলে ফ্রিজে না-রেখেও খাবার টাটকা রাখা যায়। তা ছাড়া, সেকেলে মা-দিদারাও তো নুন-তেল-চিনির মতো সাধারণ জিনিসই প্রিজারভেটিভ হিসেবে ব্যবহার করতেন।”
নুনে চুবিয়ে রাখা শুঁটকি মাছ, ঘরোয়া আচার-কাসুন্দি থেকে জনাইয়ের কালজয়ী মনোহরা-সন্দেশেও আদতে এই ঘরোয়া প্রিজারভেটিভেরই মহিমা। মনোহরার কথাই ধরা যাক। ওর গায়ে চিনির মোড়কটা যে আসলে গরমের দেশে নরম পাক সুখী সন্দেশের আয়ু বাড়ানোর কৌশল, তা প্রথম সারির মিষ্টি-স্রষ্টা মাত্রেই স্বীকার করেন। রসিক মিষ্টিখোর তাই আগে ডিমের খোলা ছাড়ানোর মতো ওই চিনি ফেলে তবে সন্দেশটা খেতেন! |