ওষুধের গুণমানের পরীক্ষাতেই রয়েছে গলদ। সেই ফাঁক গলে এ দেশে ব্যবহারের ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে প্রথম বিশ্বের দেশগুলিতে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া বেশ কিছু ওষুধ। এই পর্যবেক্ষণ খোদ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির। এ কারণে তারা ওষুধের গুণমান পরীক্ষার গোটা পদ্ধতিটাই আমূল বদলের সুপারিশ করেছে।
সংসদে পেশ করা রিপোর্টে কমিটি বলেছে, যে ভাবে এ দেশে ওষুধের গুণমান পরীক্ষা হয়, তা ত্রুটিপূর্ণ। কমিটি বলেছে, কোনও ওষুধের ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে তিন দফায় ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ চালাতে হয়। সেখানে মানব শরীরের উপর ওষুধের কোনও কুপ্রভাব পড়ছে কি না, তা দেখা হয়। ভারতের মতো দেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করেন। এঁদের মধ্যে কোন ওষুধ কতটা কাজ করছে, তা দেখারও নিয়ম রয়েছে। বড় শহরে সব ধরনের মানুষ থাকেন বলেই সাধারণত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য বড় শহরগুলি বেছে নেওয়ার শর্ত রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, এ জন্য ছোট শহরগুলিকে বেছে নিচ্ছে ওষুধ সংস্থাগুলি। তাই ওষুধের পরীক্ষা যথাযথ ভাবে হচ্ছে না।
এর ফলে উন্নত দেশে নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন ওষুধ এ দেশে ছাড়পত্র পেয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ সংসদীয় স্থায়ী কমিটির। তাদের বক্তব্য, এর মূলে রয়েছে ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থা, চিকিৎসক-বিশেষজ্ঞদের একাংশ এবং সরকারি ড্রাগ নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার মধ্যে ‘অশুভ আঁতাঁত’। রিপোর্ট বলছে, ২০০৮-এর জানুয়ারি থেকে ২০১০-এর অক্টোবরের মধ্যে ৩১টি ওষুধকে ছাড়পত্র দিয়েছে সিডিএসসিও। অর্থাৎ, গড়ে মাসে একটি করে ওষুধকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।
ওষুধের ছাড়পত্র দেওয়ায় গলদটা কোথায়, তা জানতে ৪২টি ওষুধ বেছে নিয়েছিল কমিটি। এর মধ্যে পেফ্লোক্সাসিন, লোমেফ্লোক্সাসিন ও স্পারফ্লোক্সাসিনের মতো তিনটি বিতর্কিত ওষুধের ছাড়পত্র সংক্রান্ত ফাইলই খুঁজে পাওয়া যায়নি। এই তিনটি ওষুধের বিক্রি আমেরিকা, কানাডা, ব্রিটেনের নিষিদ্ধ। বাকি ৩৯টি ওষুধের ছাড়পত্র সংক্রান্ত ফাইল ঘেঁটে জানা গিয়েছে, ১৩টি ওষুধের উন্নত দেশে বিক্রির অনুমতি নেই। সেগুলির এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে, এমনও নয়। ডিনজিট নামের একটি ওষুধ ডেনমার্কে তৈরি ও রফতানির অনুমতি থাকলেও সে দেশে বিক্রির অনুমতি নেই। ভারতে এই ওষুধ বিক্রির ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছে ডেনমার্কের সংস্থা। ১১টি ওষুধের ক্ষেত্রে তৃতীয় দফায় ‘ট্রায়াল’-ই হয়নি।
সংসদীয় কমিটির ওই রিপোর্টের ভিত্তিতে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের ফার্মাকোলজির অধ্যাপক তাপস ভট্টাচার্য বলেন, “বিদেশি ওষুধকে ছাড়পত্র দেওয়া নিয়ে যা হচ্ছে, তা বেআইনি ও অনৈতিক। তৃতীয় দফার ট্রায়াল হয়নি, এমন ওষুধের পক্ষে কী ভাবে কিছু চিকিৎসক সওয়াল করলেন, তা বুঝতে পারছি না। বিদেশে ট্রায়াল হয়েছে কি না, ধর্তব্যই নয়। কারণ, আমেরিকায় যে ওষুধে টাকে চুল গজাবে, এখানে তা কার্যকর না-ও হতে পারে।” কেন্দ্রের ড্রাগ কন্ট্রোলার জেনারেল জি এন সিংহ রিপোর্টটি নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। তবে জানান, অনিয়ম যাতে না হয়, তা নিশ্চিত করতে তাঁর সংস্থা বদ্ধপরিকর। ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির সংগঠন ওপিপিআই (অর্গানাইজেশন অফ ফার্মাসিউটিক্যাল প্রোডিউসার্স)-র বক্তব্য, ওষুধের ছাড়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে যে পরীক্ষা ও নথিপত্রের প্রয়োজন হয়, তা মেনে চলতে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তবে তারাও মেনে নিয়েছে, কমিটির রিপোর্ট যথেষ্ট উদ্বেগের।
কী বলছেন সংসদীয় কমিটির রিপোর্টে অভিযুক্ত কলকাতার চিকিৎসকরা? ‘প্রিম্যাচিওর ইজাকুলেশন’ বন্ধে একটি ওষুধকে ছাড়পত্র দিয়েছিলেন ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসক, যাঁর রিপোর্টের সঙ্গে অন্য বিশেষজ্ঞদের রিপোর্টের বয়ান হুবহু মিলে গিয়েছে। সংসদীয় কমিটি এর সমালোচনা করেছে। ওই চিকিৎসক বৃহস্পতিবার বলেন, “কার চিঠির কী বয়ান, সেটা তো আমার জানার কথা নয়। আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত রিভিউ আর্টিকলের উপরে ভিত্তি করে মতামত চেয়েছিল, দিয়েছি। ব্যস, আর কিছু জানি না।”
হেপাটাইটিস বি-এর ওষুধের ছাড়পত্র দিয়ে অভিযুক্ত আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের এক চিকিৎসকের মন্তব্য, “মতামত দেওয়ার ক্ষেত্রে ডিসিজিআই-এর একটা বয়ান আছে। সেই অনুযায়ী হয়তো লিখেছি।” নিউট্রিশন্যাল সাপ্লিমেন্টের ওষুধকে ছাড়পত্র দিয়ে সমালোচিত এসএসকেএম-এর এক চিকিৎসক বলেন, “ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল ছাড়া বাজারে ছাড়া যেতে পারে, এমন শংসাপত্র দিইনি।”
|
যেখানে গলদ |
• কিছু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের অনুমোদন-চিঠির ভাষা হুবহু এক
• দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একই দিনে সুপারিশ দিল্লিতে
• এক সুপারিশে ড্রাগ কন্ট্রোলের নাম ৩ জনই ভুল লিখেছেন
• বিদেশি ওষুধ এ দেশে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়াই চালু হচ্ছে
• শুধু আন্তর্জাতিক জার্নালের রিপোর্টের ভিত্তিতেই ছাড়পত্র
• বিশেষজ্ঞের মত ছাড়াও বহু ওষুধ বাজারে ঢালাও বিক্রি
• ওষুধ বাজারে ছাড়ার পরে তার গুণ নিয়ে সমীক্ষা হয় না
• কিছু শহরে কিছু ওষুধের নাম-কা-ওয়াস্তে ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা
• নানা বর্ণ-জাতির উপরে পরীক্ষা ছাড়াই উতরে গিয়েছে ওষুধ |
|
আট সুপারিশ |
• অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মেডিক্যাল কাউন্সিলে যাক কেন্দ্র
• সরকারি হাসপাতালের বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধে যথাযথ তদন্ত
• ওষুধের মান বাড়াতে কেন্দ্র কড়া ওষুধনীতি তৈরি করুক
• ওষুধের মান যাচাইয়ের কমিটিতে বিশেষজ্ঞের সংখ্যা বৃদ্ধি
• বিশেষজ্ঞের নাম ঠিক করুক ড্রাগ কন্ট্রোল, তা গোপন থাকুক
• বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করার নিয়মের আমূল পরিবর্তন চাই
• ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার যথাযথ নিরীক্ষণের ব্যবস্থা চাই
• ওষুধ পরীক্ষার নামে প্রহসন যাতে না হয় তা দেখতে কমিটি |
|
|