বাম জমানার বোঝা থেকে ‘মুক্তি’ মেলেনি! তাই রাজ্যের অসংগঠিত শ্রমিকদের ‘সামাজিক মুক্তি’ পেতে দেরি হচ্ছে! ক্ষমতা বদলের পর বছর ঘুরলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারকে নজর দিতে হচ্ছে বিগত জমানার ‘অনিয়মে’র কিনারা করতে।
অসংগঠিত শ্রমিকদের সুবিধার্থে সামাজিক সুরক্ষার নানা প্রকল্পকে এক জায়গায় এনে তাঁদের হাতে ‘সামাজিক মুক্তি’ কার্ড তুলে দেওয়ার ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা। কার্ড তৈরি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল গত এপ্রিলেই। আপাতত প্রকল্পের কাজের যা অগ্রগতি, তাতে শ্রম দফতরের আশা, জুন মাসে প্রথম পর্বের কার্ড অসংগঠিত শ্রমিকেরা হাতে পেতে পারেন। বিলম্বের অন্যতম হেতু সামাজিক মুক্তির কাজ করতে করতেই অনলাইন নথিভুক্তিকরণের প্রক্রিয়া ঢেলে সাজতে হচ্ছে! রাজ্য সরকারের বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আনার জন্য অসংগঠিত শ্রমিকদের অনলাইনে নাম নথিভুক্তির প্রক্রিয়া চালু করে গিয়েছিল বাম সরকারই। কিন্তু সেই কাজে বড়সড় ‘বেনিয়মে’র অভিযোগ ওঠে শ্রম দফতরে। বাম জমানার শেষ দিকে নির্দিষ্ট একটি সংস্থার সফ্টঅয়্যার একতরফা ভাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছিল বলে ‘জলঘোলা’ হয়। টেন্ডারের শর্তে এমন কিছু ‘জটিলতা’ রাখা হয়েছিল, যার জন্য টেন্ডারে অন্য অংশগ্রহণকারীরা তাদের প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাবই দিতে পারেনি বলে অভিযোগ করে শ্রম দফতরে চিঠি পাঠিয়েছিল ‘মাইক্রোসফ্ট’ সংস্থা। কিন্তু বাম সরকার সেই অভিযোগকে গুরুত্ব দেয়নি। বিষয়টির কোনও সুরাহাও হয়নি।
ওই ঘটনায় যে সব আধিকারিকের নাম জড়িয়েছিল, তাঁরাও রয়ে গিয়েছেন শ্রম দফতরে। এখন হাতে-কলমে কাজ করতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ে বর্তমান সরকারের শ্রম দফতর অনলাইন নথিভুক্তির পুরো প্রক্রিয়াটি নতুন করে সাজাচ্ছে। শ্রমমন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুর কথায়, “বাম জমানার ওই ঘটনা আমাদের নজরে এসেছে। আমরা নতুন করে টেন্ডার ডেকে প্রক্রিয়াটি ফের সম্পন্ন করছি। ‘ওয়েবেল’কে (সরকারি সংস্থা) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।” বস্তুত, শ্রম দফতর সূত্রের খবর, সফ্টঅয়্যার ব্যবহারের সম্ভাব্য সব দিক খতিয়ে না-দেখে বাম জমানায় ওই অনলাইন ব্যবস্থা চালু করে দেওয়ায় এখন নানা সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। রাজ্যের বেশ কিছু জায়গায় অনলাইন নাম নথিভুক্তির কাজ আটকেও গিয়েছে। চন্দননগরের ডেপুটি লেবার কমিশনারের দফতরে যেমন অনলাইন ব্যবস্থা এখনও চালু করা যায়নি। হাতে কাজ হচ্ছে। আবার হাওড়া, কল্যাণী বা হলদিয়ায় আংশিক হলেও অনলাইনে কাজ হচ্ছে। এ ভাবে চললে সামাজিক মুক্তি কার্ডের আত্মপ্রকাশ কি আটকে যেতে পারে? পূর্ণেন্দুবাবুর বক্তব্য, “কাজ চলছে। আশা করছি, জুনে অন্তত প্রথম দফার কার্ড হয়ে যাবে।”
সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য এবং বাম আমলের শ্রমমন্ত্রী অনাদি সাহু অবশ্য অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, “টেন্ডার ডেকে নিয়ম মেনেই কাজ হয়েছিল। তবে প্রযুক্তিগত বিষয়ে কিছু শুরু করার পরে অভিজ্ঞতা থেকে আরও ভাল কাজ করা যায়। আমরা শুরুটা করেছিলাম। এখন সেই কাজই এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।” শ্রম দফতরের একাংশের বক্তব্য, অনলাইন তথ্য অন্তর্ভুক্তি ছাড়াও আরও কিছু ‘জটিলতা’ সামাজিক মুক্তি প্রকল্পে আছে। অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, নির্মাণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, পরিবহণ শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা, বিড়ি শ্রমিক কল্যাণ এমন নানা প্রকল্প এখন চালু আছে। নির্মাণ, পরিবহণ এবং অন্যান্য অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য আলাদা আলাদা কল্যাণ পর্ষদও আছে। তাদের আওতাধীন প্রকল্পগুলিকে এক জায়গায় এনে একটা কার্ড তৈরি করায় ‘জটিলতা’ আছে বলেই শ্রম আধিকারিকদের একাংশের অভিমত। ঘটনাচক্রে, প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের বক্তব্যও তা-ই! অনাদিবাবুর কথায়, “নির্মাণ, পরিবহণ ও অন্য অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য আমরা আলাদা পরিচয়পত্র এবং পাসবই চালু করতে গিয়েছিলাম। যাতে ওই পরিচয়পত্র সঙ্গে থাকলে কোনও শ্রমিক দুর্ঘটনায় পড়লে ব্যবস্থা নেওয়া যায়। আমাদের আমলে বিষয়টা ছিল সামাজিক সুরক্ষা। এখন বলা হচ্ছে সামাজিক মুক্তি!”
প্রাক্তন শ্রমমন্ত্রীর আরও আক্ষেপ, “সাজানো বাগান রেখে এসেছি! শুধু নির্মাণ শ্রমিকদের কল্যাণ পর্ষদেই চারশো কোটি টাকা ছিল!” বর্তমান শ্রমমন্ত্রী বুঝছেন, বাগানে ফুলের পাশে কাঁটাও ছিল! |