রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করে উপাচার্য নিয়োগে সার্চ কমিটি গড়ার কথা বলা হয়েছে ঠিকই। কিন্তু নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বিগত এক বছরে রাজ্যের যে প্রান্তেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের পদ খালি হয়েছে, সেখানেই অস্থায়ী ভাবে কাউকে নিয়োগ করা হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সার্চ কমিটি গড়ার প্রক্রিয়াটাই শুরু হয়নি। কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাছাইয়ের জন্য দু’টি সার্চ কমিটি গড়া হলেও এখনও তাদের সুপারিশ মেলেনি বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু।
বাম আমলে উপাচার্য নিয়োগে বহু ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যই মাপকাঠি ছিল বলে বিধানসভা নির্বাচনের আগে সরব হয়েছিল তৃণমূল। ক্ষমতায় এসে বিশ্ববিদ্যালয় আইন সংশোধন করেছে তারা। বলা হয়েছে, এ বার থেকে উপাচার্য বাছাই করবে বিশিষ্ট শিক্ষাব্রতীদের নিয়ে গড়া সার্চ কমিটি। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে উপাচার্য নিযুক্ত হলে নিয়োগ প্রক্রিয়াটি হবে স্বচ্ছ এবং রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত। শিক্ষাজগতের সঙ্গে যুক্ত অনেকেই নতুন সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু সিদ্ধান্তটি কার্যকর
করার ক্ষেত্রে সরকার গড়িমসি করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। |
রাজ্যের ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ন’টিতেই এখন অস্থায়ী উপাচার্য। অল্প কিছু দিনের মধ্যেই গৌড়বঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের কার্যকাল শেষ হবে। গৌড়বঙ্গে ইতিমধ্যেই অস্থায়ী ভাবে উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অচিন্ত্য বিশ্বাস। যে হেতু রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বাছাইয়ের জন্যও সার্চ কমিটি গড়া হয়নি, তাই সেখানেও অস্থায়ী ভাবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে ধরেই নিয়েছে উচ্চশিক্ষা দফতর। তখন অস্থায়ী উপাচার্যের সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়াবে ১২-এ।
এ ভাবে প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ কেন, তা নিয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে অস্থায়ী উপাচার্যদের বাছাই নিয়েও। কারণ প্রচলিত প্রথা ভেঙে যাদবপুর ও উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি রাজ্য সরকারই উপাচার্য নিয়োগ করেছে। আচার্য নয়। সার্চ কমিটি গড়তে এত দেরি হচ্ছে কেন? উচ্চশিক্ষা দফতরের বক্তব্য, সার্চ কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও এক জনের থাকার কথা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোই সেই নাম পাঠাতে দেরি করছে।
সার্চ কমিটি গড়ে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে সরকারকে কটাক্ষ করেছেন রাজ্যের প্রাক্তন উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী সুদর্শন রায়চৌধুরী। তাঁর প্রশ্ন, “যে সরকার এত তৎপর, তারা সার্চ কমিটি গড়ার কাজে এমন গাফিলতি দেখাচ্ছে কেন? অস্থায়ী উপাচার্যরা নিযুক্ত হচ্ছেনই বা কী ভাবে? যাঁরা নিযুক্ত হচ্ছেন, তাঁদের সবাই খুব নিরপেক্ষ বলে তো জানা নেই! কেউ কেউ তো বিভিন্ন চ্যানেলে বসে শাসক দলের মতই ব্যক্ত করেন।” শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “অস্থায়ী উপাচার্য পদে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা কেউই দলীয় সদস্য নন। প্রত্যেকেই নামী শিক্ষক। যা হচ্ছে, আইন মেনেই হচ্ছে।”
উপাচার্য নিয়োগের ব্যাপারে বর্তমান রাজ্য সরকারের কাজকর্মে প্রবীণ শিক্ষকদের কেউ কেউ অবশ্য বাম আমলেরই ছায়া দেখছেন। তাঁদের মতে, যে ভাবে আলিমুদ্দিন থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পছন্দের ব্যক্তিদের বসিয়ে দেওয়া হত, এখনও কার্যত তাই-ই হচ্ছে। ছ’মাস বা এক বছরের জন্য অস্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ করে তাঁদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার বিভিন্ন কমিটিতে নিজেদের পছন্দের লোকেদের ভিড় বাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। সুতরাং পরে বাছাই কমিটি মারফত অন্য কেউ স্থায়ী ভাবে উপাচার্যের পদে এলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাশ কার্যত থেকে যাবে দলীয় অনুগতদেরই হাতে। শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, “শিক্ষাব্রতীদেরই কমিটিতে রাখা হচ্ছে। ব্যক্তিগত পছন্দের জায়গা নেই।” অথচ এমন অভিযোগও তো রয়েছে যে, কোথাও কোথাও খোদ উচ্চশিক্ষা সংসদের পক্ষ থেকেই পছন্দের লোকেদের নামের তালিকা ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে উপাচার্যদের হাতে। এক শিক্ষক বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলে কলেজ অধ্যক্ষদের ভিতর থেকে কয়েক জনকে মনোনীত করার কথা উপাচার্যের। দেখা গিয়েছে, বর্ধমান, কল্যাণী-সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে উচ্চশিক্ষা সংসদই তালিকা পাঠিয়ে বলে দিয়েছে, কাদের মনোনীত করতে হবে।”
সার্চ কমিটি না হওয়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের ব্যাখ্যা কী? উচ্চশিক্ষা দফতরের এক কর্তা বলেন, “সার্চ কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মনোনীত এক জনের থাকার কথা। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ই এখনও তাদের পছন্দের ব্যক্তির নাম পাঠাতে পারেনি।” কেন? বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাফাই বিভিন্ন রকম। কোথাও মামলার জন্য কোর্টের বৈঠক আটকে রয়েছে। ফলে বিশেষজ্ঞের নাম ঠিক করা যাচ্ছে না। কোথাও আবার বৈঠক হলেও বিষয়টি আলোচিতই হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত এক কর্তার মতে, যাঁরা ছ’মাস বা এক বছরের জন্য উপাচার্য নিযুক্ত হয়েছেন, তাঁরা স্বভাবতই চাইবেন না, তাঁদের মেয়াদ ফুরনোর অনেক আগেই স্থায়ী উপাচার্য নিযুক্ত হয়ে যান। ফলে তাঁরাও অনেকে এই ব্যাপারে গড়িমসি করতে পারেন। |