নেহাতই আগ্রহ আর কৌতুহল থেকে চাষ করা শুরু। তবে, নদিয়ার ফুলিয়া কিংবা বাঁকুড়ার সোনামুখীতে চাষিদের খেত ভরেছে স্ট্রবেরিতে। লাভের মুখ দেখে তাঁরা ঠিক করেছেন, ধান-গমের ‘অনিশ্চিত’ ফলনে নয়, এ বার থেকে ভরসা রাখবেন স্ট্রবেরির বিকল্প চাষেই।
মহারাষ্ট্রের মহাবালেশ্বরে স্ট্রবেরির চাষ নতুন নয়। কিন্তু ঊষর বাঁকুড়া কিংবা নদিয়ার ফুলিয়ার উষ্ণ আবহাওয়ায় স্ট্রবেরি চাষের কথা মাথায় এসেছিল স্থানীয় কিছু কৃষিজীবীরই। ঝুঁকি নিয়ে করা সেই চাষ লাভের মুখ দেখিয়েছে বলেও দাবি করেছেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, চাষিরা জানান, মুম্বই এমনকী, ব্যাঙ্কক থেকে বিমানে চারা আনিয়েও তাঁরা এতটাই লাভ ঘরে তুলেছেন যে, আগামী মরসুম থেকে অর্থকরী এই ফসলের চাষের উপরেই ভরসা করছেন তাঁরা। তাঁদের সাফল্য দেখে এগিয়ে এসেছেন আরও কয়েকজন।
বিকল্প চাষে নদিয়া জেলার এই উদ্যোগ নজরে এসেছে মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়ের। মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি পরামর্শদাতা প্রদীপ মজুমদার বলেন, “বিকল্প চাষের প্রসারে মুখ্যমন্ত্রী উদ্যোগী হয়েছেন। নদিয়ায় স্ট্রবেরি চাষ তারই অন্যতম।” |
রণডিহা মানা এলাকায় স্ট্রবেরি চাষ। বিশ্বনাথ মশানের তোলা ছবি। |
এ রাজ্যে স্ট্রবেরি চাষের অন্যতম পথিকৃত নদিয়ার ফুলিয়ার বাসিন্দা সহদেব বসাকের পারিবারিক পেশা তাঁত বোনা। একই সঙ্গে তাঁর আগ্রহ চাষ-আবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। সেই আগ্রহ থেকেই সহদেববাবু স্ট্রবেরি চাষ শুরু করেছিলেন গত বছর। অল্প জমিতে করলেও আয় নেহাত কম হয়নি। চলতি মরসুমে তিনি দু’বিঘা জমিতে বাণিজ্যিক ভাবে স্ট্রবেরি চাষ করেছেন। সহদেববাবু বলেন, “মহারাষ্ট্র থেকে তিন হাজার চারা এনে লাগিয়েছিলাম। চারা পিছু দাম পড়েছিল ৩০ টাকা, বিমানে নিয়ে আসতে খরচ হয় আরও ২০ টাকা। সব মিলিয়ে খরচ হয়েছিল প্রায় দেড় লক্ষ টাকা। কিন্তু স্ট্রবেরি বিক্রি হয়েছে আড়াই লক্ষ টাকায়। বিক্রি হয়েছে মূলত পাঁচতারা হোটেল আর বড় শপিং মলগুলিতে।”
বাঁকুড়ার সোনামুখীর উত্তর বেশিয়া-অমৃতাপাড়ার কার্তিক মজুমদার, বলাই কীর্তনিয়া, রমেশ মণ্ডল, কিরণ মণ্ডল, রমণী সরকার এবং রঞ্জিৎ বণিক অবশ্য স্ট্রবেরি চাষ করেছেন অনেকটা ছোট আকারে। তবে লাভের মুখ
দেখেছেন তাঁরাও। রমেশবাবু তাঁর তাইল্যান্ড-প্রবাসী ভাই মারফত স্ট্রবেরির চারা আমদানি করেন। ছয় জন চাষি এই প্রথম বার প্রায় ১০ কাঠা জমিতে স্ট্রবেরি লাগিয়েছেন। রমেশবাবুুর বক্তব্য, “স্ট্রবেরি চাষ নিয়ে একটা লেখা পড়েছিলাম। মনে হল, আমরাও এখানে ওই চাষ করতে পারি। আশা, করি, পরের বার আরও ভালো ফলন পাব।”
সহদেববাবু আবার স্ট্রবেরি থেকে জ্যাম-জেলি তৈরি করছেন। সেই জ্যাম-জেলি বাজারে আনবেন তাঁদের ফার্মার্স ক্লাবের নামে। প্রায় আড়াইশো চাষিকে নিয়ে যে ২৮টি ফার্মার্স ক্লাব আছে ফুলিয়ার গ্রামে, তারাও এ বার স্ট্রবেরি চাষে আগ্রহী হয়েছে। সহদেববাবু জানান, ফুলিয়ায় অন্তত পনেরো জন চাষি ১৮ বিঘা জমিতে স্ট্রবেরি চাষ করছেন।
কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সরোজকুমার সান্যাল বলেন, “স্ট্রবেরি অত্যন্ত অর্থকরী চাষ। নদিয়ায় চাষিরা ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই চাষ শুরু করেছেন। বাণিজ্যিক ভাবে স্ট্রবেরি চাষের ব্যাপারে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়েরও কিছু নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা রয়েছে।”
এ রাজ্যে ‘সুইট চার্লি’ আর ‘তায়োগা’ এই দু’জাতের স্ট্রবেরির চাষ হচ্ছে। ‘সুইট চার্লি’ আকারে ছোট কিন্তু বেশ মিষ্টি। আর ‘তায়োগা’ একটু টক, কিন্তু তা সংরক্ষণ করা সুবিধাজনক। চাষিদের দাবি, ঠিকঠাক চাষ ও ফলন হলে গড়ে প্রতি কেজি স্ট্রবেরিতে লাভ প্রায় ৩০০ টাকা। প্রতি বিঘায় প্রায় ৭৫ হাজার টাকা লাভ করা সম্ভব। সেপ্টেম্বর মাসে চারা লাগিয়ে নভেম্বর মাস থেকে ফলন পাওয়া যায়। এপ্রিল মাস পর্যন্ত ফলন হয়। এক বার চাষ করলে পরের বছরের জন্য চারা নিজেরাই তৈরি করতে পারেন চাষিরা। চাষ করতে সস্তার জৈব সারই যথেষ্ট।
প্রতিদিন মহারাষ্ট্র থেকে তিন লরি বোঝাই স্ট্রবেরি আসে এ রাজ্যে। আগামী দিনে সেই ভূগোলে কি নদিয়া, বাঁকুড়া জায়গা করে নেবে? সহদেববাবুরা সেই ভরসাতেই বুক বেঁধেছেন।
|
(সহ প্রতিবেদন: সুব্রত সীট) |