বিদ্যুৎ-চিত্রের উলটপুরাণ!
আগামী বছর ভরা গ্রীষ্মেও রাজ্যে প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থেকে যাবে। তার পর সময় যত যাবে, ততই বাড়বে উদ্বৃত্ত বিদ্যুতের পরিমাণ। রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের হিসেব অন্তত সেই কথাই বলছে।
বাড়তি বিদ্যুতের এই অঙ্কটা কোনও ভোজবাজি নয়। ঘোরতর বাস্তব। এবং সেই বাস্তবটা রাজ্যের শিল্পায়নের বিবর্ণ চিত্র। বিদ্যুৎ দফতরের সূত্র বলছে, রাজ্যে নতুন নতুন শিল্প আসবে, এই আশা মাথায় রেখে বিদ্যুতের জোগান বাড়ানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। তাতে পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির সংস্কারের পাশাপাশি নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। সেই সব চেষ্টার ফল আগামী বছর থেকে ফলতে শুরু করবে।
কিন্তু ইতিমধ্যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পর থেকে রাজ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া কার্যত থমকে গিয়েছে। ফলে বিদ্যুতের চাহিদা যে পরিমাণে বাড়বে বলে অঙ্ক কষা হয়েছিল, বাস্তবে তার ধারে কাছে যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, ২০১১-১২ আর্থিক বছরে রাজ্যে যেখানে কমপক্ষে ৮ শতাংশ হারে বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাবে বলে ধরা হয়েছিল, বাস্তবে তা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪ শতাংশে। নতুন শিল্প না এলে চলতি অর্থবর্ষে এবং তার পরেও বিদ্যুতের চাহিদা বিশেষ বাড়বে না বলেই কর্তাদের একাংশ মনে করছেন। রাজ্যের এক বিদ্যুৎ কর্তা বলেন, “আমরা হিসেব করে দেখেছি, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দিনের সর্বাধিক চাহিদার সময়েও রাজ্যে গড়ে ১১০০ থেকে ১৩০০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকবে।” এই বাড়তি বিদ্যুৎ কোন কাজে লাগবে, তার কোনও দিশা এখনও খুঁজে পায়নি বিদ্যুৎ দফতর। অন্য রাজ্যে বিদ্যুৎ বিক্রির চেষ্টা করতে হবে তাদের। |
বিদ্যুৎ চিত্র |
|
২০১৩-’১৪ |
২০১৪-’১৫ |
২০১৫-’১৬ |
২০১৬-’১৭ |
|
গরমে চাহিদা |
৮৩৬২ |
৯১৪১ |
৯৯৯৩ |
১০৯২৪ |
|
সরবরাহ ক্ষমতা |
৮৮২৩ |
৯৪০২ |
১০২১৩ |
১১৮৮৮ |
|
* হিসেব মেগাওয়াট প্রতিদিন |
* সূত্র: বিদ্যুৎ দফতর |
|
|
রাজ্যের বিদ্যুৎমন্ত্রী মণীশ গুপ্ত অবশ্য শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়া বা কমে যাওয়ার যোগাযোগ নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাননি। উল্টে তিনি বলেন, “রাজ্যে বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত হচ্ছে, এটা আমাদের সবার কাছে খুশির খবর। এতে দেশ-বিদেশের শিল্পমহলও এ রাজ্যে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে।” বিদ্যুৎমন্ত্রীর দাবি, চাহিদামতো বিদ্যুৎ পাওয়াটা লগ্নিকারীদের অন্যতম দাবি থাকে। পশ্চিমবঙ্গ সে ক্ষেত্রে অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় এক ধাপ এগিয়েই থাকবে। চাইলেই যত খুশি বিদ্যুৎ দেওয়া যাবে।
আগামী আর্থিক বছর থেকে কী পরিমাণ বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত থাকবে, তার একটি পরিসংখ্যান সম্প্রতি রাজ্যের পক্ষ থেকে যোজনা কমিশনের কাছে দেওয়া হয়েছে। ওই তথ্যের ভিত্তিতেই দেশের মধ্যে ‘বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত রাজ্য’ হিসেবে গুজরাতের পরেই পশ্চিমবঙ্গের নাম দ্বিতীয় স্থানে চলে আসবে বলে বিদ্যুৎ দফতরের দাবি।
যদিও শিল্পমহলের একাংশের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় গুজরাতে মাথা-পিছু বিদ্যুতের ব্যবহার প্রায় তিন গুণ বেশি। তার উপরে ওই রাজ্যে প্রতি বছরই বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে। তা সত্ত্বেও গুজরাত বিদ্যুৎ-উদ্বৃত্ত রাজ্য হয়েছে। অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গে চাহিদা নেই বলেই বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত হচ্ছে। তাই গুজরাতের পাশে পশ্চিমবঙ্গের নাম আনা খানিকটা বাহুল্যই হয়ে যায় বলে তাঁদের অভিমত।
বাম আমলে গরমের সময় প্রতি বছরই ভাল রকম বিদ্যুৎ ঘাটতি হতো। তবে ২০০৭ সালের পর থেকে রাজ্যে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সংস্কার শুরু হয়। রাজ্যের প্রাক্তন বিদ্যুৎমন্ত্রী নিরুপম সেন বলেন, “২০০৫-০৬ সালের পর থেকে রাজ্যে শিল্পায়ন প্রক্রিয়া জোরকদমে শুরু হয়ে গিয়েছিল বলেই বিদ্যুতের চাহিদা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছিল। ভবিষ্যতে চাহিদা আরও বাড়বে ধরে নিয়েই আমাদের আমলে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে সংস্কারের পাশাপাশি কয়েকটি নতুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনাও নেওয়া হয়।”
বিদুৎ ক্ষেত্রে সংস্কারের মধ্যে প্রথমেই পুরনো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলির দিকে নজর দেওয়া হয়। আগে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি সর্বোচ্চ ক্ষমতার তুলনায় অনেক কম বিদ্যুৎ উৎপাদন করত। পেশাদারি দক্ষতা বাড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন (পরিভাষায় যাকে বলে প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর) বাড়ানো হয়। পাশাপাশি, কম চাহিদার সময় অন্য রাজ্যকে বিদ্যুৎ বেচে ভরা মরসুমে তা ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থাও (বিদ্যুৎ ব্যাঙ্ক) গড়ে তোলা হয়। বিদ্যুৎ কেনার জন্য বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিও করা হয়েছে।
এর সঙ্গে দ্বাদশ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মধ্যে (২০১২-১৭) রাজ্যে বেশ কয়েকটি নতুন বিদ্যুৎ প্রকল্পের নির্মাণ এবং পুরনো ইউনিটের সংস্কার শেষ হয়ে যাবে। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে ৫০০ মেগাওয়াট করে যে দু’টি ইউনিটের কাজ চলছে ২০১৫ সালের মধ্যে সেগুলিতে উৎপাদন শুরু হবে। ওই সময়ই উৎপাদন শুরু করবে ডিপিএলের ২৫০ মেগাওয়াটের আরও একটি ইউনিট।
এ ছাড়া, হলদিয়ায় সিইএসসি-র ৬০০ মেগাওয়াটের তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ওই সময়ের মধ্যে চালু হয়ে যাবে। ফলে সিইএসসি-কে এখন রাজ্যের পক্ষ থেকে যে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হয়, তখন আর তা করতে হবে না। পাশাপাশি বিশ্ব ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ব্যান্ডেলের ২১০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিটটির সংস্কারও ওই সময়ের মধ্যে শেষ হবে। এই সব ক’টি ইউনিট ২০১৫-১৬ সালের মধ্যে উৎপাদন শুরু করলে রাজ্যে বিদ্যুতের ঘাটতি তো থাকবেই না, উল্টে শিল্প না হলে প্রচুর বিদ্যুৎ উদ্বৃত্তই থেকে যাবে। |