|
|
|
|
কয়লা মাফিয়াদের ‘মাথা’ হুগলির কমল গ্রেফতার |
নিজস্ব প্রতিবেদন |
আসানসোল-দুর্গাপুরকে পুলিশ কমিশনারেটের আওতায় এনে চোরাই কয়লার কারবার বন্ধ করার আশ্বাস দিয়েছিল রাজ্য প্রশাসন। খনি এলাকার তিন তাবড় মাফিয়ার পরে এ বার ‘মাথা’ কমল দাসকেও ধরে ফেলল পুলিশ।
পুলিশের দাবি, বৃহস্পতিবার হুগলির গুড়াপ থেকে আসানসোল-দুর্গাপুর কমিশনারেটের গোয়েন্দা বিভাগ কমলকে গ্রেফতার করে। কয়লাঞ্চলের বাকি মাফিয়াদের সঙ্গে তাঁর ফারাক দু’জায়গায়। এক, তিনি কয়লাঞ্চলের বাসিন্দা নন, বাড়ি হুগলির আদি সপ্তগ্রামে। দুই, পারিবারিক পরিচয় ও শিক্ষাগত যোগ্যতায় তিনি অন্যদের চেয়ে অনেকটাই আলাদা।
রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের পরেই তিন মাফিয়া কালে সিংহ, জয়দেব মণ্ডল ও রাজু ঝাকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তবে কমলকে ধরা যাচ্ছিল না। এ দিন তাঁকে ‘গ্রেফতার’ করার খবর জানিয়ে আসানসোল-দুর্গাপুর গোয়েন্দা বিভাগের এসিপি চন্দ্রশেখর বর্ধন বলেন, “শিল্পাঞ্চলের চার কুখ্যাত কয়লা মাফিয়ার মধ্যে কমল দাসই সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী। শিল্পাঞ্চলে বসবাস না করেও তিনিই কার্যত এলাকার অবৈধ কয়লার কারবারকে পরিচালনা করতেন।”
সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবার থেকে কয়লা কারবারে কমলের উত্থান ও মধ্যমণি হয়ে ওঠার কাহিনি যথেষ্ট চমকপ্রদ। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, ছোটবেলায় উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরে দিদির কাছে থাকতেন কমল। সেখানকার কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে তিনি হুগলির বাড়িতে ফেরেন।
তাঁর এক দাদা চুঁচুড়া আদালতের সরকারি আইনজীবী। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিক থেকেই কমল অবৈধ কয়লা পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। সেই সময়ে মগরা ও আদি সপ্তগ্রামের মাঝামাঝি ২ নম্বর জাতীয় সড়কে সরকারি ‘চুঙ্গি কর’ আদায় করা হত। রঞ্জিত সিংহ নামে কর আদায়ের এক এজেন্ট গুলিতে খুন হন। পাল্টা গুলিতে জখম হন কমলও। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধেই খুনের অভিযোগ দায়ের হয়। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে কিছু দিন জেলও খাটেন তিনি। এ ছাড়া, মগরায় একটি হোটেল মালিককে খুন ও নিজের ভায়রাভাইকে খুনের ঘটনাতেও তিনি অভিযুক্ত ছিলেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কমল থাকতেন আদি সপ্তগ্রামেই। অবৈধ কয়লা কারবারের পাশাপাশি তাঁর আরও কিছু ব্যবসা রয়েছে। পেট্রোল পাম্প, ইটভাটা চালানোর পাশাপাশি ইদানীং ব্যান্ডেল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই অন্যত্র সরবরাহের কাজও করছিলেন তিনি। খনি এলাকার অবৈধ খাদান থেকে কয়লা তোলার পরে তা ২ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে হুগলি হয়ে কলকাতার দিকে চলে যায়। অবৈধ কয়লা বোঝাই গাড়ির চালককে মাফিয়াদের লোকজন নির্দিষ্ট ছবি আঁকা একটি ছাপা কাগজ (একে বলে ‘প্যাড’) দেয়। তা দেখালে রাস্তায় অবৈধ কয়লার গাড়ি ধরতেন না কিছু অসাধু পুলিশকর্মী। আসানসোল থেকে পালশিট পর্যন্ত নানা ভাগে চলত জয়দেব, রাজু ও কালে সিংহের ‘প্যাড’। পালশিট থেকে ডানকুনি পর্যন্ত পৌঁছতে হলে কিনতে হত কমল দাসের ‘প্যাড’। পুলিশ জানায়, কমলের প্যাডের দামই
ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ, তা না কিনলে হুগলি বা কলকাতায় কয়লা ঢুকত না। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্তা
ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের মোটা টাকার ভেট দিয়ে রমরমিয়ে এই বেআইনি ব্যবসা চালিয়ে গিয়েছেন কমল।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সম্প্রতি কমল একটি ভুয়ো পুলিশের দলও তৈরি করেছিলেন। পালশিট পেরোনোর পরে বৈধ কয়লা নিয়ে যাওয়া গাড়িগুলিকেও আটকাত তারা। অতিরিক্ত কয়লা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দাবি করে প্রথমে ‘জরিমানা’ আদায় করা হত। পরীক্ষা করার অছিলায় গাড়ির চালকের থেকে পরিবহণের কাগজপত্র নিয়ে তা ছিঁড়ে ফেলে দিত তারা। এর পরেই কুড়ি হাজার টাকার বিনিময়ে ‘প্যাড’ কেনার জন্য চাপ দিত। তা কিনতে রাজি না হলে পুলিশের কাছে অবৈধ কয়লা পাচার হচ্ছে বলে ‘খবর’ দেওয়া হত। বৈধ কয়লা পরিবহণে যুক্ত এক কর্মী বলেন, “পুলিশ গাড়ি আটক করলে ফের কাগজপত্র জোগাড় করে তা ছাড়াতে ৫-৭ দিন পেরিয়ে যেত। গাড়ি ভাড়া হিসেবে অতিরিক্ত টাকা গুনতে হত। এ সব ঝামেলা থেকে বাঁচতে বৈধ কয়লার গাড়িও ‘প্যাড’ কিনত।”
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, তিনটি খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগ ছাড়াও খনি এলাকার নানা থানায় কমলের বিরুদ্ধে অবৈধ কয়লা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বছর ষোলো আগে কুলটি থানার পুলিশ তাঁকে এক বার গ্রেফতারও করে।
গত এক বছরে পরপর তিন মাফিয়া গ্রেফতার হওয়ার পরে আসানসোলে পুরো অবৈধ কয়লার কারবারের নিয়ন্ত্রণই চলে গিয়েছিল কমলের হাতে। তাঁর সঙ্গী হন প্রেম অগ্রবাল নামে এক ব্যক্তি। মাস তিনেক আগে রানিগঞ্জ থেকে প্রেমকে গ্রেফতার করা হয়। তার পর থেকেই কমলের খোঁজ চলছিল। ধরার পরে তাঁকে জেরা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। আজ, শুক্রবার তাঁকে আসানসোল আদালতে তোলা হবে। |
|
|
|
|
|