বাবা তাকে রেখে গিয়েছেন বর্ধমানের বেসরকারি হাসপাতালে।
প্রায় দেড় মাস হয়ে গেল।
মাস দুয়েকের মাতৃহারা মেয়েটির হৃদ্-যন্ত্রে জটিল সমস্যা। ভাল রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে দূষিত রক্ত। বারে বারেই নীল হয়ে যাচ্ছে শরীর। ডাক্তারেরা বলছেন, দ্রুত অস্ত্রোপচার জরুরি। দেরি হলে বাঁচানো যাবে না।
অথচ তার বাবা আসছেন না।
আপাতত যন্ত্রের সাহায্যে কৃত্রিম ভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস টিকিয়ে রাখা হয়েছে শিশুটির। কিন্তু অস্ত্রোপচারের জন্য যে ধরনের পরিকাঠামো প্রয়োজন তা ওই হাসপাতালে নেই। দুর্গাপুরের একটি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথা বলেছে জেলা প্রশাসন। তারা রাজি। অভিভাবকের সম্মতি পেলেই শিশুটিকে সেখানে পাঠিয়ে অস্ত্রোপচার করানো সম্ভব।
অথচ বাবা আসছেন না। |
বর্ধমানের একটি বেসরকারি হাসপাতালে তোলা নিজস্ব চিত্র। |
গত ১৭ মার্চ বর্ধমানের কাছেই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপরে ওই হাসপাতালে শিশুটিকে ভর্তি করিয়েছিলেন তার বাবা, বীরভূমের ময়ূরেশ্বর এলাকার মল্লারপুরের বিনোদ পান্ডে। পারিবারিক ওষুধের ব্যবসা আছে তাঁর। পরে কয়েক বার মেয়েকে দেখতেও এসেছেন তিনি। মাসখানেক হল আর আসছেন না। হাসপাতাল থেকে তাঁকে বারবার খবর দেওয়া হয়েছে। গত ২৫ এপ্রিল বর্ধমানের জেলাশাসক, পুলিশ সুপার, স্থানীয় থানাকে লিখিত ভাবে জানিয়েওছে তারা।
হাসপাতালের অন্যতম অধিকর্তা সৌমেন্দ্র সাহা শিকদারের কথা, “শিশুটির হৃদ্-যন্ত্রে অক্সিজেনবাহী পরিশ্রুত রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কার্বন ডাই-অক্সাইড যুক্ত দূষিত রক্ত। সেই দূষিত রক্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়াতেই শিশুটি মাঝে-মধ্যে নীল হয়ে যাচ্ছে। ওর ফুসফুসেও নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি রক্ত চলে যাচ্ছে। এখন কৃত্রিম উপায়ে আমরা শ্বাসপ্রশ্বাস টিকিয়ে রেখেছি। কিন্তু অবিলম্বে অস্ত্রোপচার না হলে বাঁচানো যাবে না। শিশুটির বাবা রোজই বলছেন, ‘কাল আসব।’ আচমকা কিছু হয়ে গেলে তার দায়িত্ব তো আমাদের ঘাড়েই চাপবে!”
জেলাশাসক ওঙ্কার সিংহ মিনা বলেন, “আমরা সমস্ত ব্যবস্থা করে রেখেছি। শিশুটির বাবা কিংবা কোনও অভিভাবক এসে তাকে স্থানান্তরিত করার কাগজপত্রে সই করে দিলেই উপযুক্ত গাড়ির ব্যবস্থা করে দুর্গাপুরের হাসপাতালে সরিয়ে নিয়ে যাব। কিন্তু কেউ আসছেন না।” তাঁর দফতর থেকে বিনোদবাবুর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। বর্ধমানের হাসপাতাল থেকে এক কর্মী মল্লারপুরে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছেন। সকলকেই তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু সোমবার পর্যন্ত আসেননি।
এ দিন বিনোদবাবু অবশ্য জানান, মূলত টাকার অভাবেই তিনি মেয়ের কাছে যেতে পারছেন না। মল্লারপুর থেকে টেলিফোনে তিনি বলেন, “বর্ধমানের একটি নার্সিংহোমে মেয়ের জন্মের পরেই আমার স্ত্রী মারা যান। মেয়ে হার্টের দোষ নিয়ে জন্মানোয় ওকে হাসপাতালে ভর্তি করাই। এখন যেতে পারছি না শুধু টাকার অভাবে। স্ত্রী ও মেয়ের জন্য আগেই প্রচুর খরচ হয়েছে। তার উপরে কয়েক দিন আগে আমার ভাইয়ের তিন বছরের শিশুও ব্লাড ক্যান্সারে মারা গিয়েছে। তাই আমি আর বর্ধমানে যেতে পারিনি।”
হাসপাতালের তরফে সৌমেন্দ্রবাবু অবশ্য বলেন, “শিশুটির চিকিৎসার খরচ লাখ ছাড়িয়ে গিয়েছে। ওর বাবা শুরুতেই হাজার পঞ্চাশেক টাকা জমা করেছিলেন। বাচ্চাটির মুখ চেয়ে বাকি টাকা আমরা ছেড়ে দিতে রাজি আছি।” দুর্গাপুরের সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের সিইও সত্যজিৎ বসুর আশ্বাস, “বাচ্চাটির চিকিৎসার পুরো খরচ আমরাই বহন করব। বাড়ি থেকে এক পয়সাও দিতে হবে না।”
বিনোদবাবু বলেন, “মঙ্গলবার অবশ্যই মেয়ের কাছে যাব।”
সত্যিই আসবেন তো? |