আর্সেনিক-এর পাশাপাশি নয়া বিষ। ফ্লুওরাইড। ভারতে এর প্রকোপ
বহু দিনের।
পশ্চিমবঙ্গে নতুন।
আক্রান্ত বীরভূম, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া।
বিশেষ করে,
পুরুলিয়ায় দূষণের মাত্রা বিপজ্জনক। লিখছেন
দেবদূত ঘোষঠাকুর |
আর্সেনিক তো আছেই। এবার তার দোসর হল ফ্লুওরাইডও। গভীর এবং অগভীর নলকূপ ব্যবহার করে চাষের কাজে এবং পানীয় জল সরবরাহের মাত্রা যত বাড়ছে ততই নামছে ভূগর্ভের জল। আর্সেনিকের পাশাপাশি রাজ্যের নতুন নতুন এলাকার পানীয় জলে মিলছে বিপজ্জনক মাত্রার ফ্লুওরাইড। মৃত্যুর মুখে ঠেলে না দিলেও, দীর্ঘদিন বিপজ্জনক মাত্রার ফ্লুওরাইড শরীরে ঢুকলে তা মানুষকে পঙ্গু করে দিতে পারে। এই বিপদের কথা রাজ্য সরকারের অজানা নয়। অন্য কোনও ভাবে পানীয় বা সেচের জল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় শহরে তো বটেই, গ্রামেও গভীর-অগভীর নলকূপের উপরে নির্ভরতা বাড়ছে। বাড়ছে আর্সেনিকোসিস (আর্সেনিক বিষক্রিয়া) এবং ফ্লুওরোসিস (ফ্লুওরাইড বিষক্রিয়া) অসুখের রোগী।
বীরভূমের নলহাটি ১ নম্বর ব্লকের কিছু নলকূপে বিপজ্জনক মাত্রার ফ্লুওরাইড ধরা পড়েছিল ১৯৯৭ সালে। সহনমাত্রার বেশি পরিমাণ ফ্লুওরাইড মিলেছে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জ, বংশীহারী, বীরভূমের সিউড়ি ২ নম্বর এবং সাঁইথিয়া ব্লকে। সোনারপুর-রাজপুর পুরসভার কিছু এলাকার নলকূপের জলেও মিলেছে উচ্চ মাত্রার ফ্লুওরাইড (রাজ্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের রিপোর্ট)। বীরভূমের পাশাপাশি পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার বিভিন্ন অংশেও যে বিপজ্জনক মাত্রার ফ্লুওরাইড মিলবে জিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার গবেষকেরা জানিয়েছিলেন। পুরুলিয়ার তিনটি ব্লকে ইতিমধ্যেই বিপজ্জনক মাত্রার ফ্লুওরাইড পেয়েছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ভূতত্ত্ব এবং পরিবেশবিদ্যা ম্যানেজমেন্ট বিভাগের গবেষকেরা। তাঁরা বাঁকুড়াতেও সমীক্ষা শুরু করবেন।
আর্সেনিক দূষণ মোকাবিলার জন্য রাজ্য সরকার নব্বই দশকের মাঝামাঝি তৈরি করেছিল আর্সেনিক টাস্ক ফোর্স। কয়েক বছর আগে ফ্লুওরাইড টাস্ক ফোর্স-ও তৈরি হয়। তারাই প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত ভূতত্ত্ব এবং পরিবেশবিদ্যা ম্যানেজমেন্ট বিভাগকে রাজ্যের কোথায় কোথায় ভূগর্ভস্থ জলে ফ্লুওরাইড দূষণ হচ্ছে তা খুঁজে বার করার দায়িত্ব দেয়। পুরুলিয়াকে সমীক্ষার কেন্দ্র হিসেবে ধরে সমীক্ষার কাজ শুরু করেছিল ওই বিভাগ।
সমীক্ষক দলের প্রধান হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য এবং সমীক্ষক দলের অন্যতম গবেষক শরদিন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, “পুরুলিয়ার তিনটি ব্লক, পুরুলিয়া ১, পুরুলিয়া ২ এবং হুড়ায় পানীয় জলে ফ্লুওরাইডের পরিমাণ যে বেশি তা প্রাথমিক সমীক্ষাতেই ধরা পড়েছিল। ওই ফ্লুওরাইড কোথা থেকে আসছে এবং তা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কী তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা।” ফ্লুওরাইডের উৎস এবং তার পরিমাণ জানার জন্য ৪০১টি নমুনা সংগ্রহ করেছেন সমীক্ষকেরা। তার মধ্যে ২৪২টি পাথরের নমুনা এবং ১৫৯টি জলের নমুনা। নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে পাথর ড্রিল করে, কুয়ো থেকে এবং নলকূপ থেকে। |
প্রাণদায়ী। কিন্তু, ফ্লুওরাইড? পুরুলিয়া, ২০১২। ছবি: প্রদীপ মাহাতো |
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী পানীয় জলে ফ্লুওরাইডের সহনমাত্রা প্রতি লিটার জলে ১.৫ মিলিগ্রাম। তথ্য বলছে, পুরুলিয়া ১ নম্বর ব্লক থেকে সংগ্রহ করা ৩৮টি জলের নমুনায় সবচেয়ে বেশি মাত্রায় ফ্লুওরাইড লিটারে ১০.৭৫ মিলিগ্রাম। পুরুলিয়া ২ নম্বর ব্লক থেকে সংগ্রহ করা ৪৮টি জলের নমুনায় ফ্লুওরাইডের সর্বোচ্চ মাত্রা লিটারে ৬.২৫ মিলিগ্রাম। হুরা ব্লকে ৭৩টি জলের নমুনায় ফ্লুওরাইডের সর্বোচ্চ পরিমাণ লিটারে ৬.২৫ মিলিগ্রাম। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, ৫৪ শতাংশ জলের নমুনায় প্রতি লিটারে ১ মিলিগ্রামের থেকে বেশি ফ্লুওরাইড রয়েছে। এই ৫৪ শতাংশের মধ্যে ১৭ শতাংশে আবার প্রতি লিটারে ১.৫ মিলিগ্রামের বেশি ফ্লুওরাইড রয়েছে।
কেন এতটা ফ্লুওরাইড দূষণ? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষকেরা বলছেন, পুরুলিয়ার ওই এলাকা মূলত ছোটনাগপুরের নিস কমপ্লেক্সের গ্রানাইট এবং নিস পাথর দিয়ে তৈরি। তাতে রয়েছে ফ্লুওরাইড মিশ্রিত খনিজ অ্যাপাটাইট এবং অভ্রের আকর বাওটাইট। ওই দুই খনিজ থেকেই ফ্লুওরাইড চুঁইয়ে এসে মিশেছে পানীয় জলের সঙ্গে।
হরেন্দ্রনাথবাবু এবং শরদিন্দ্রবাবু জানাচ্ছেন, পুরুলিয়া পশ্চিমবঙ্গের আধা-মরু অঞ্চল। এই অঞ্চলে দীর্ঘ দিন ধরে জল তোলার ফলে ভূগর্ভের ফ্লুওরাইড জলে মিশতে শুরু করেছে। পুরুলিয়ায় ভূস্তরের নীচে তিনটি স্তরে জল সঞ্চিত রয়েছে। অগভীর, মাঝারি এবং গভীর। অগভীর জলস্তর থেকে সাধারণ কুয়োর মাধ্যমে জল তোলা হয়। সেখানে ফ্লুওরাইড নেই। কিন্তু ব্যাক্টেরিয়া থাকে। মাঝারি এবং গভীর জলস্তরে ব্যাক্টেরিয়া নেই কিন্তু ফ্লুওরাইডযুক্ত পাথরের স্তর রয়েছে। হরেন্দ্রবাবুরা মনে করছেন, ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত জল তুলে নেওয়ায় পুরুলিয়ার বহু জায়গায় প্রথম এবং দ্বিতীয় স্তরে আর জল নেই। তাই তৃতীয় স্তরের জলস্তর (৩০০ ফুট গভীর)- য়ের উপরেই মানুষকে ভরসা করতে হচ্ছে। ফ্লুওরাইড দূষণের আশঙ্কা বাড়ছে।
বহু যুগ ধরেই তো পুরুলিয়ার ওই এলাকার ভূস্তরের গঠন এমন। তাহলে এখন নলকূপের জলে ফ্লুওরাইড মিলছে কেন? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূবিজ্ঞানীদের দাবি, বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক, জলতাত্ত্বিক, ভৌত এবং রাসায়নিক প্রক্রিয়ার জন্যই ফ্লুওরাইড মিশ্রিত পাথর থেকে ভূস্তরের জলে ফ্লুওরাইড ছড়াচ্ছে। মরু এবং আধা-মরু অঞ্চলে আবহাওয়ার ভৌত এবং রাসায়নিক কারণে অতি ক্ষারকীয় জলের সঙ্গে পাথরের বিক্রিয়ায় ফ্লুওরাইড দূষণ ছড়ায়। ওই অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত জলের নমুনা থেকে দেখা গিয়েছে, পুরুলিয়ার উচ্চ ফ্লুওরাইড দূষিত এলাকায় ভূস্তরের জলে সোডিয়াম-পটাশিয়াম-হাইড্রোকার্বনের অস্তিত্ব রয়েছে। এর ফলে ফ্লুওরাইড মিশ্রিত পাথর থেকে জলে ফ্লুওরাইড দূষণ ছড়াচ্ছে।
সমীক্ষকেরা দেখেছেন, যে সব গ্রামবাসী এই দূষিত জল পান করছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই ফ্লুওরোসিস রোগে আক্রান্ত। এই রোগের লক্ষণ, দাঁত হলদে হয়ে ভেঙে যাওয়া, গাঁটে ব্যথা, পেশীতে টান, দ্রুত বার্ধক্য। প্রাথমিক মেডিক্যাল টেস্টে দেখা গিয়েছে, মূলত ডেন্টাল এবং স্কেলিটাল ফ্লুওরোসিস এই অঞ্চলে ছড়াচ্ছে। ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, গুজরাত, রাজস্থান, পঞ্জাব, হরিয়ানা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, ওড়িশা, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি এবং কেরলে ফ্লুওরোসিস রোগ বহুদিনের পুরনো। সাম্প্রতিক সংযোজন পশ্চিমবঙ্গ এবং অসম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানাচ্ছে, বিশ্বে ৬০ লক্ষ শিশু-সহ প্রায় ৬ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ এই দূষণের ফলে ফ্লুওরোসিস রোগে আক্রান্ত।
এই রোগের একমাত্র দাওয়াই আক্রান্ত মানুষকে ফ্লুওরাইডমুক্ত জল খেতে দেওয়া। আর্সেনিক দূষণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়ও তাই।
|