|
|
|
|
প্রবন্ধ ১... |
জানেন কি, ৯৯ থেকে ১০০ ঠিক কত দূর? |
মাত্র ১? মোটেই নয়। একশো মানে এক শূন্য শূন্য। ভারত জানে,
শূন্যের কী মহিমা!
তাই,
সচিন নিরানব্বইটি শতরানে পৌঁছে
শততম-র
জন্যে
আকুল হতেই পারেন। শূন্য শুধু শূন্য নয়। লিখছেন পথিক গুহ |
সচিন তেন্ডুলকর দ্বিতীয়বার নিন্দার মুখোমুখি। পরিস্থিতির কী ফারাক! এর আগে তিনি সমালোচিত হয়েছিলেন এক ব্যর্থতার কারণে। তাঁর অধিনায়কত্বে ভারতীয় টিমের সাফল্য তেমন আসছিল না। আবার তিনি সমালোচিত। হায়, এ বার কিন্তু বিরাট এক সাফল্যের পরেও। একশোটি সেঞ্চুরি করার পরে তিনি কাঠগড়ায়। কেন? ৯৯তম সেঞ্চুরি থেকে পরেরটিতে পৌঁছোনোয় অত্যধিক বিলম্ব। ফর্ম পড়ন্ত, সুতরাং শততম শতরানের অপেক্ষায় না থেকে খেলা থেকে তাঁর অবসর নেওয়া উচিত ছিল বলে মনে করেন কেউ কেউ। সচিনের কাঙ্ক্ষিত রেকর্ডটি যখন মনে হচ্ছিল আলেয়ার আলো, তখন তো ব্যঙ্গ ভরে এক ভাষ্যকার এমনও দাবি করেছিলেন যে, ক্রিকেটারের মনোবাসনা পূর্ণ করতে তাঁকে একটা ‘সাম্মানিক শতরান’ দিয়ে দেওয়া হোক। নিন্দার জবাবে সচিন ছিলেন নির্বাক।
শততম সেঞ্চুরিটি হাঁকড়ানোর পরে অবশ্য সচিন মুখ খুলেছেন। খোলারই কথা। কারণ, এ বার তিনি নানা অনুষ্ঠানে মিডিয়ার মুখোমুখি। ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় দল যখন পরপর পরাজয়ের লজ্জায় নতশির, তখন যিনি এক বারও ম্যাচশেষে ভাষ্যকারের মুখোমুখি হননি, তিনি এ বার টেলিভিশনের পর্দায়, ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানির সামনে। এবং, সেই সুযোগে, সমালোচকদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ। জানিয়েছেন, অবসর নেওয়ার আদৌ কোনও অভিপ্রায় তাঁর নেই। কখন তিনি অবসর নেবেন, সে ব্যাপারে সমালোচকেরা তাঁকে পরামর্শ দেওয়ার কে?
হক কথা। পরামর্শ অগ্রাহ্য করার অধিকার ফান্ডামেন্টাল রাইট। বিশেষত, তা যদি নিন্দুকদের তরফে আসে। তবে, পরামর্শ খারিজের পেছনে সচিন যে যুক্তি দিয়েছেন, তা বিচার্য। তাঁর মতে, কেউ যখন শীর্ষে থাকে, তখন তার দেশকে সেবা করা উচিত। ‘যখন বুঝব যে আর দেশকে সেবার পরিস্থিতিতে নেই, তখন অবসর নেব। অন্য কেউ যখন বলছে, তখন নয়। শীর্ষে থাকার অবস্থায় অবসর নিতে বলাটা স্বার্থপরতা।’ |
|
একাই একশো। শততম শতরানের পরে সচিন-বন্দনা। কলকাতা, ২০১২। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
বলা বাহুল্য, ওই মন্তব্য করে সচিন বাড়িয়েছেন বিতর্ক। তিনি কি সত্যিই এখন টপ ফর্মে? গত ৮ টেস্ট ম্যাচে তাঁর গড় রান ৩৫। যাঁর কেরিয়ার অ্যাভারেজ ৫৫.৪৪, তাঁর ক্ষেত্রে গড়ে ৩৫ রান কি শীর্ষে থাকার নমুনা? ৯৯তম সেঞ্চুরি থেকে ১১তম সেঞ্চুরিতে পৌঁছোতে যে ৩৩টি ইনিংস খেলেছেন তিনি, সেগুলিতে তাঁর গড় রান ৩৩-এর কম। এটাও টপ ফর্ম? অন্তত তাঁর অতীত ইতিহাসের বিচারে? পরিসংখ্যান, অতএব, সমর্থন করে না তাঁর দাবি।
জনৈক ভাষ্যকার সঙ্গত কারণেই সচিনের শততম সেঞ্চুরির লক্ষ্যে দৌড়কে তুলনা করেছেন আর এক প্রাতঃস্মরণীয় ক্রিকেটারের আচরণের সঙ্গে। তিনি ডোনাল্ড জর্জ ব্র্যাডম্যান। রেকর্ড গড়ার বাসনা, হতো বা, ছিল তাঁরও। কিন্তু তা সত্ত্বেও অবসর গ্রহণের আগাম ঘোষণা থেকে এক চুল নড়েননি তিনি। শেষ যে ইনিংসটি খেলেছিলেন, তাতে মাত্র ৪ রান করলেই তাঁর টেস্ট গড় হত ১০০। অথচ, ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এই অস্ট্রেলীয় সেই ইনিংসে আউট হয়েছিলেন ০ রানে। টেস্টে লোভনীয় গড়ের রেকর্ড বিনে শেষ হয়েছিল তাঁর খেলোয়াড়জীবন। হোক, তাতে কি। রেকর্ডটি না-ছোঁয়ায় একটুও কমেছে কি ব্র্যাডম্যানের ভক্তের সংখ্যা?
সচিনও বোধহয় ১০০-র মোহমুক্ত হতে পারতেন। হলেন না। কেন? বন্ধু ক্রীড়া সাংবাদিক এ প্রশ্নের একটা উত্তর দিয়েছেন তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে। বলেছেন, সচিন ভারতীয় বলেই বোধহয় পড়েছিলেন ১০০-র মোহে। তাঁর শততম সেঞ্চুরির তৃষ্ণায় দেশবাসী এমন চাতক পাখির মতো বসে ছিল যে, আর সেই প্রত্যাশার পারদ মিডিয়া এত চড়িয়েছিল যে, ব্যাপারটা পৌঁছেছিল পাগলামির পর্যায়ে। কী রকম? বন্ধু সাংবাদিকের মন্তব্য, ‘দেশের নানা শহরে ক্রিকেট ম্যাচ কভার করতে হোটেলে উঠেছি। তো সচিনের ব্যাটিং থাকলেই ম্যানেজার থেকে বেয়ারা পর্যন্ত সবার এক প্রশ্ন দাদা, আজ ওঁর শততম সেঞ্চুরি হচ্ছে তো? এমন হলে সচিন মোহাবিষ্ট হবেনই।’
|
সংখ্যা-দর্শন! |
সন্তুষ্ট হওয়া গেল না যুক্তিতে। মানা গেল শুধু এটুকু যে, ১০০-য় মোহাবেশ সচিনের একার নয়, অসংখ্য মানুষের। সচিন কেবল সেই বহু-র মধ্যে এক। আসলে, সবার চিন্তা চেতনাই সংখ্যায় আচ্ছন্ন। সংখ্যা মানুষের অস্তিত্বের অস্থিমজ্জায়। তার জীবন বাঁধা আছে সংখ্যার নোঙরে। একটা দিন, এমনকী একটা ঘণ্টাও, সে কাটাতে পারে না সংখ্যার বিস্তীর্ণ জালের বাইরে। সময়ের হিসেব, অর্থের লেনদেন, তথ্য পরিবেশন কিংবা অনুধাবনের প্রক্রিয়া এ সবের সমষ্টির নাম জীবন। আর এর প্রতিটি ক্রিয়ার পরতে পরতে মিশে আছে সংখ্যা। এক দুই তিন-এর পর্যাপ্ত ব্যবহার বিনে সভ্যতা পঙ্গু। পঙ্গু নয়, বলা ভাল মৃত।
সংখ্যার সঙ্গে মানুষের মানসিক যোগাযোগ গবেষণা করতে বসে বিজ্ঞানীরা থ’ বনে গেছেন। দেখেছেন, গণিত স্কুলে শেখার বিষয় নয়। মানবশিশু গণিতের ধারণা নিয়েই জন্মায়। কী রকম? পরীক্ষা প্রমাণ করেছে, দু’দিন বয়েস যে শিশুর, সেও পারে সাধারণ যোগ-বিয়োগ করতে! তা কী ভাবে সম্ভব? দু’দিনের বাচ্চা তো ভাষা বোঝে না। তাকে হোম টাস্ক দেওয়া যায় কেমন করে? না, বিজ্ঞানীরা তাঁদের সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন বিশেষ পরীক্ষার ফলে। ওঁরা দেখেছেন, শিশু বস্তুর (ধরা যাক, ঝুনঝুনি) সংখ্যার ফারাক শনাক্ত করতে পারে। একটা, দুটো কিংবা তিনটে ঝুনঝুনি যে আলাদা ব্যাপার, তা শিশু টের পায়। একটা এবং অন্য একটা একটা ঝুনঝুনি মেলালে তখন যে আর একটা মাত্র ঝুনঝুন থাকে না, সেটা বুঝতে পারে। আবার, দুটো থেকে একটা সরালে যে আর দুটো ঝুনঝুনি থাকে না, তাও টের পায়। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, একটা সরালে যে আর একটাই ঝুনঝুনি থাকে, ঝুনঝুনির সংখ্যা শূন্যে নেমে আসে না, সেটাও বুঝতে পারে।
মস্তিষ্কের সঙ্গে গণনক্ষমতার যোগাযোগ এখন গবেষণার মস্ত বিষয়। বিজ্ঞানের যে শাখায় এর চর্চা হয়, তার পোশাকি নাম ‘কগনিটিভ নিউরোসায়েন্স’। এর গবেষকেরা আবিষ্কার করেছেন এক গূঢ় সত্য। দেখেছেন, গণনকৌশল মানব চরিত্রের ভীষণ মৌলিক এক লক্ষণ। এ গুণ ভাষা অর্জনের ক্ষমতার চেয়ে বেশি মৌলিক। এই উপলব্ধি থেকে এটা বলাই যায় যে, মানুষ যদি ভাষার ব্যবহার না শিখত, তা হলেও তার মধ্যে থাকত সংখ্যা নাড়াচাড়ার দক্ষতা। বিজ্ঞানীরা যাকে বলেন ‘নিউমেরোসিটি’। সংখ্যাজ্ঞান। মানবমস্তিষ্কে এর উৎসস্থলটিও খুঁজে পেয়েছেন গবেষকেরা। যে অংশ নাড়াচাড়া করে সংখ্যা, তার নাম ‘লেফ্ট পারিয়েটাল লোব’। মজার ব্যাপার, ওই অংশের সঙ্গে যোগাযোগ আবার হাতের আঙুলের। হয়তো এ জন্যই সংখ্যা গোনার কাজে আঙুলের ব্যবহার এত স্বাভাবিক প্রবৃত্তি।
সংখ্যার চেতনা যদি সর্বজনীন হয়, তবে ১০০-র প্রতি বিশেষ প্রেম কি একান্ত ভারতীয় ভাবাবেগ? হতে পারে? সংখ্যা হিসেবে ১০০ যে ৯৯-এর পরের সংখ্যা হয়েও তার চেয়ে অনেক বড় কিছু, চরিত্রে ৯৮-এর যত কাছে ৯৯, ঠিক ততটা কাছাকাছি যে নয় ৯৯ এবং ১০০, তা একজন ভারতীয় যদি বেশি মাত্রায় উপলব্ধি করে, তা হলে তাকে দোষ দেওয়া যায় না। এ হেন চেতনার প্রথম উন্মেষ তো এই ভারতেই।
বিশ্বের গণিতমহলে বহুবিখ্যাত সেই মন্তব্যটি স্মরণ করুন। ইন্ডিয়া কন্ট্রিবিউটেড জিরো টু ম্যাথমেটিক্স। এখানে জিরো মানে নাথিং নয়। জিরো মানে শূন্য চিহ্নটি (০)। ওহ্, কী ভীষণ দামি এক চিন্তা। ভারতে সপ্তম শতাব্দীর ওই আবিষ্কার অকস্মাৎ বদলে দিয়েছিল গণনাকৌশল। সহজ হয়েছিল হিসেব। এবং সে কারণে যেন স্বর্গ নেমে এসেছিল দুনিয়া জুড়ে বিকিকিনির হাটে।
শূন্যের ধারণা কী ভাবে সহজ করে দিল হিসেব-কিতেব? সংখ্যা লেখার রোমান পদ্ধতির কথা ভাবা যাক। জটিলতা যার সর্বঅঙ্গে। চিহ্নের ছড়াছড়ি। ১,২ এবং ৩ হল I, II এবং III (অর্থাৎ, ১, ১১ এবং ১১১)। ৪=IV, মানে ৫-এর ১ কম। ৫(V) যেমন একটা আলাদা চিহ্ন, তেমনই আলাদা চিহ্ন ১০(X), ৫০(L), ১০০(C) এবং ১০০০(M)। এত আলাদা চিহ্নের দরকার কেন? ০-এর ধারণা নেই বলে। আমরা জানি ৩২৭৮ আসলে ৩×১০০০+২×১০০+৭×১০+৮×১। এত বড় ব্যাপারকে কত সংক্ষেপে লেখা হয় ৩২৭৮। এই হ্যাপা সামলানোর ক্ষমতা নেই বলে রোমানে ৩২৭৮ হল MMMCCLXXVIII। অর্থাৎ কিনা ১০০০১০০০১০০০১০০১০০৫০১০১০৫১১১।
সামান্য চার অঙ্কের একটা সংখ্যা লিখতে যদি এত ঝক্কি পোহাতে হয়, তা হলে যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করতে তো দিন কাবার। ব্যবসা এগোবে কী করে? ০ হাতে পাওয়ায় জটিলতা নিমেষে উধাও। এবং সরস্বতীর গুণে ব্যবসায় লক্ষ্মী।
হাতে ০ আসায় ৯-এর থেকে ১০ অনেক দূরে। তেমনই ৯৯ থেকেও ১০০ দূরবর্তী এক সংখ্যা। সচিনের ৯৯টি শতরানে অতৃপ্ত ভারতীয় মানসিকতাকে, অতএব, দোষ দেওয়া যায় না। |
|
|
|
|
|